খেলাধুলা

আবিরের ‘আবির’ ছড়ানো ব্যাটিং

কে হবেন টপ স্কোরার- কুমার সাঙ্গাকারা? মাহেল জয়বর্ধনে? ফর্মের চূড়ায় থাকা তামিম ইকবাল? নাকি নিজেকে ফিরে পাওয়া মুশফিকুর রহীম? ক্রমেই বড় তারকার লেভেল গায়ে এঁটে যাওয়া মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ? নাকি আফগানিস্তানের মোহাম্মদ শাহজাদ? সময় যত গড়াচ্ছে, কৌতূহলি এ প্রশ্ন ততই জোরালো হচ্ছে। তবে সেই সম্ভাব্য তালিকায় যার নাম কেউ রাখেননি, সেই শাহরিয়ার নাফীসের রান রথ এখন সবচেয়ে বেশি সচল। এবারের বিপিএলে চতুর্থ রাউন্ড শেষে সর্বাধিক (১৮৪) রান তার। শুধু রান তোলায়ই সবার ওপরের নন। ফিফটি হাঁকানোয়ও সবাই শাহরিয়ার নাফীসের পেছনে। চার ম্যাচে তিনবার পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছেন বরিশাল বুলসের এ বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। এ আসরে তার ইনিংসগুলো এমন- ৫৩+১*+৬৩+৬৫। এমন নয়, শাহরিয়ার নাফীস আগে কখনো এমন খেলেননি। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে শাহরিয়ার নাফীস এক সময় ছিলেন দেশের এক নম্বর ওপেনার। ২০০৫-২০০৮ এ তাকে ভাবা হতো এক নম্বর ওপেনার। টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেরই অপরিহার্য সদস্য ছিলেন তিনি। ওই সময় টেস্ট এবং ওয়ানডে ক্যারিয়ারও ছিল তার সেরকম উজ্জ্বল। তার ব্যাট মাঠ আলোকিত করতো বলেই এক সময় ডাক নাম উঠে আসতো পত্রিকার শিরোনামে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শাহরিয়ার নাফীসের ডাক নাম- ‘ধাবির’। ‘আবির যেন মাঠে মাঠে আবির ছড়ালেন’- ফর্মের চূড়ায় থাকা অবস্থায় পত্রিকায় এমন শিরোনামও হয়েছে তাকে নিয়ে। তার এমন কিছু রেকর্ড আছে, যা বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানেরই নেই। ৭৫ ওয়ানডেতে চারবার শতরান করা শাহরিয়ার নাফীস ক্যারিয়ারে দুবার পর পর তিন ম্যাচে পঞ্চাশের ওপর রান করেছেন। প্রথম এ কৃতিত্ব দেখান ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে। যেখানে পরপর তিন ওয়ানডের দুটিতেই সেঞ্চুরি। প্রথমটি ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর ভারতের জয়পুরে। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১২৩ রানের হার না মানা ইনিংস দিয়ে শুরু। তারপর ৩০ নভেম্বর খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১০৫* এবং ৩ ডিসেম্বর বগুড়ায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৭। দুই বছর পর ২০০৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকার শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে পর পর তিন ম্যাচেই (৯০*+৬০+৫৪) তিনটি ফিপটি। এতো গেল একদিনের ক্রিকেটে শাহরিয়ার নাফীসের মাঠ মাতানো পারফরম্যান্সের নমুনা। ছোট্ট পরিসংখ্যান। টেস্টেও কম যাননি। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান, যার আছে অস্ট্রেলিয়ার মত পরাক্রমশালী দলের বিপক্ষে টেস্ট সেঞ্চুরি। ২০০৬ সালের এপ্রিলে ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামে ব্রেট লি, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক, জেসন গিলেসপির মত তিন তুখোড় ফাস্ট বোলারের সঙ্গে দুই লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন ও স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের গড়া ধারালো ও শক্তিশালী অজি বোলিংয়ের বিপক্ষে সাড়ে চার ঘণ্টার বেশি (২৭৪ মিনিট) সময় ক্রিজে কাটিয়ে ১৮৯ বলে ১৮ বাউন্ডারিতে ১৩৮ রানের দারুণ এক দ্যুতিময় ইনিংস খেলেছিলেন, যা এখনো সবার মনের আয়নায় জ্বলজ্বল করছে। সেই শাহরিয়ার নাফীস দীর্ঘদিন পর নিজেকে ফিরে পেতে প্রাণপণ সংগ্রাম করছেন। মাঝে বেড়ে যাওয়া ওজন কমিয়ে ফেলেছেন অনেক। যারা এক বছর আগে শাহরিয়ার নাফীসকে দেখেছেন, তারা হয়তো দেখেও বিশ্বাস করতে পারবেন না। ওজন কমিয়ে ঝরঝরে হয়ে ওঠা শাহরিয়ার নাফীস যেন নতুনভাবে নিজেকে ফিরে পেলেন। চপলতা এবং ক্ষিপ্রতা বেড়েছে। একটু আলগা বল পেলেই ব্যাটে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে উইকেটের সামনে ও দুদিকে শট খেলার সামর্থ্যও বেড়েছে অনেক। উইকেট ছেড়ে এক-দুই পা বেরিয়ে মারতে চাইলেই পারছেন। শরীর, ডান পা এবং ব্যাট সবই বলের ঠিক পিছনে চলে যাচ্ছে, যা গত দু-তিন বছর যায়নি। তার প্রমাণ এবারের বিপিএলে তিন ম্যাচে সাত ছক্কা হাঁকানো। অফ স্টাম্পের বাইরে একটু খাটো লেন্থের বল পেলেই কাট, ফুল লেন্থ ডেলিভারি পাওয়া মাত্র কভার বা অন ড্রাইভ আর লেগ মিডলের ওপর গুডলেন্থ ডেলভারির বিরুদ্ধে অন সাইডে লং অন ও ওয়াইড লং অনের ওপর দিয়ে তুলে মারছেন অবলীলায়। সেগুলো হয় এক ড্রপে চার হচ্ছে। না হয় সীমানার বাইরে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। অগ্রজ শাহরিয়ার নাফীসের আলো ছড়ানো ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ তার দল বরিশাল বুলস অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। আর আজ যে দল বরিশালের কাছে হারল, সেই চিটাগাং ভাইকিংস ক্যাপ্টেন তামিম ইকবাল মনে করেন, এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত সেরা ব্যাটিং করেছেন শাহরিয়ার নাফীস। প্রথম ম্যাচ শেষে দুই অধিনায়কের আনুষ্ঠানিক মিডিয়া সেশনে একটা সময় হলো শাহরিয়ার নাফীস বন্দনা। দল হারার হতাশা ও যন্ত্রণার কথা বলতে গিয়েও শাহরিয়ার নাফীসের প্রসঙ্গ উঠতেই তামিম ইকবালের প্রশংসা, ‘বলতে পারেন এই মুহূর্তে বিপিএলে সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং করছেন আবির ভাই (শাহরিয়ার নাফীস)। আমি তার শেষ ইনিংসটা মাঠে বসে দেখেছিলাম। প্রথম ইনিংসটাও টিভিতে দেখেছি। আমার কাছে মনে হয়, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে রান করার জন্য উনি অনেক কাজ করেছেন এবং সফলতাও পাচ্ছেন। অনেস্টলি স্পিকিং, আমিও তার ব্যাটিং খুব উপভোগ করছি। যে শটসগুলা আগে তিনি খেলতেন না, এখন সেগুলোও খেলছেন।’ ঠিক তামিম ইকবালের সুরে সুর মিলিয়েছেন মুশফিকুর রহীমও। বরিশাল বুলস অধিনায়কের মূল্যায়ন, ‘শাহরিয়ার নাফীস ভাই অসাধারণ খেলেছেন। তিনি অনেক পরিশ্রম করেছেন। আমাদের সাথে এক মাস ট্রেনিং করেছেন। তখনো দেখেছি তাকে প্রচুর ঘাম ঝরাতে। আমার মনে হয়, কষ্টের ফসল বলতে যা বোঝায় এখন আবির ভাই তা পাচ্ছেন। তিনি এমন কিছু শটস খেলছেন, যা আগে খেলতেন না। ইমরুল ভাইও (ইমরুল কায়েস) নিজেকে এভাবে তৈরি করে ফেলেছেন। আমার মনে হয় আবির ভাই এখন অনেক বেশি ফিট। শটস খেলার ইচ্ছা ও সামর্থ্য দুই-ই বাড়িয়ে ফেলেছেন। এ কারণেই তার ব্যাটিংটা বেশি চোখে পড়ছে। তিনি আগের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক ও চোখ জুড়ানো শটস খেলতে পারছেন। রানও হচ্ছে বেশি।’ এআরবি/আইএইচএস/এমএস

Advertisement