বিশেষ প্রতিবেদন

বিচার বিভাগে ‘দ্বৈত শাসন’ নিয়ে আইনজীবীরা যা বলছেন

প্রায় এক দশক আগে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ করা হয়েছে বিচার বিভাগ। কিন্তু নিম্ন আদালতে বিচারক বদলি, নিয়ন্ত্রণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর ও শৃঙ্খলাভঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণে পৃথক সচিবালয় গঠন করা হয়নি। এসব ব্যবস্থা গ্রহণে আইন মন্ত্রণালয়ের ওপরেই বিচার বিভাগকে নির্ভর করতে হয়। এজন্য বিচার বিভাগে ‘দ্বৈত শাসন’ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি। অনেক আইনজীবীর মতে, এ পৃথকীকরণের পরিপূর্ণতা এখনো আসেনি। ফলে এর সুফল মিলছে না। তাই বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রধান বিচারপতির পক্ষে মত দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অনেক আইনজীবী। আবার কেউ কেউ ভিন্ন মত দিয়ে বলছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার সুফল পাওয়ার কাছাকাছি চলে এসেছে। এ নিয়ে সংবিধান এবং আইনজ্ঞেরা জাগো নিউজের কাছে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নয় বছর পূর্তিতে দেয়া বাণীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা বলেছেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে অধস্তন সব আদালতের ওপর হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।কিন্তু সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিমকোর্টের পক্ষে এককভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এরূপ দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্য পদে সময়মতো বিচারক নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন করা ‘সময়ের দাবি’ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। ওই বিধানটি পুনঃপ্রবর্তন করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরো সমুন্নত ও সংহত হবে এবং বিচার বিভাগের সার্বিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হবে।’এরপর আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে যে কথা বলেছেন, তা স্ববিরোধী। তাই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি যেটা বলেছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি।এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট (বার) আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রধান বিচারপতি ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে ফিরে যেতে বলেছেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান তা বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছিল। এরপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ আন্দোলনের পর ‘মাসদার হোসেন’ মামলার রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে। অধস্তন আদালতের পদোন্নতি, বদলি এক সময় আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতো।’তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় এবং প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন আমরা তার কাছাকাছি চলে এসেছি। বাকিটা সময়ের ব্যাপার।’তিনি আরো বলেন, ‘সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়েছে জিয়াউর রহমানের সময়। যেহেতু ‘মাসদার হোসেন’ মামলার রায়ে বলা হয়েছে কীভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে। এই প্রশ্নে বিচার বিভাগ স্বাধীনতার কাছাকাছি এসেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘এখন সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ না নিয়ে কিছু করা হয় না। বিচার বিভাগের সব নিয়োগে সুপ্রিমকোর্টের মতামত নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হচ্ছে।’ এ বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আরো অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কে হবেন এই দুর্গম অভিযাত্রী দলের কাণ্ডারি?’এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এটি সরকারের সিদ্ধান্ত এবং উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার অফিস সাচিবিক সহায়তা দেন। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রমোশন, বদলি করে সরকার সুপ্রিমকোর্টের অনুমোদন নিয়ে। এখানে সংবিধান ও রুলস অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ নয় বছর আগে পৃথক করা হলেও এখনো কিছু সমস্যা রয়েছে। সব সমস্যা দিনে দিনে দূর হবে। এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সরকার আন্তরিক।’ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন করা হলে পুরো বিচার বিভাগের কাজে গতিশীলতা আসবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন হাইকোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির ওপর পড়ে, এতে আপিল বিভাগের আইনের ব্যাখ্যার মতো মূল ভূমিকা নির্লিপ্তভাবে পালন করতে সমস্যা হয়। সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের অধীনে সচিবালয় হলে আপিল বিভাগ সেসব কাজ করতে পারতো।’বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ চলমান প্রক্রিয়া। আমি আশা করব, ধীরে ধীরে এসব কাজ সম্পন্ন হবে।’ তিনি বলেন, ‘যাদের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথককরণ হবে তাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হতে হবে। তারা এখনো আগের কলোনিয়াল চিন্তা-ভাবনা করেন।’ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সারাদেশের নিম্ন আদালতগুলোর বিচারকদের কার্যক্রম, মামলা-মোকাদ্দমা সংক্রান্ত খোঁজ-খবর রাখার জন্য সুপ্রিমকোর্টের পক্ষে কাজ করতে একটি পৃথক সচিবালয় গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটি না হওয়ার কারণে এখনো নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, অসদাচারণের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর আমাদের নির্ভরশীল থাকতে হয়।’সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হলেও, তা পরিপূর্ণতা পায়নি। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য যে জাতীয় আয়োজন, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।’তিনি বলেন, দক্ষ বিচারক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। বিচার ব্যবস্থায় এখনও অনেক ক্ষেত্রেই মামুলি রয়েছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সংযোজন প্রত্যাশিত নয়। জনবল কাঠামো ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার তেমন উন্নয়ন না হওয়ায় স্বাধীন বিচার বিভাগ সুফল লাভ করেনি। এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি বর্তমান প্রেক্ষাপটে সঠিক কথা বলেছেন। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রকৃতপক্ষে দ্বৈত শাসনই চলছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি অত্যন্ত মেধা ও মমনশীলতা এবং বিচার বিভাগ যাতে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে সে ব্যাপারে ইতিবাচক বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ না করলে কী হবে, তা বলা হয়নি। প্রধান বিচারপতি মূলত এই বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগ এককভাবে কিছু করতে পারে না।’ তিনি আরো বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ-সম্পর্কিত ১৬তম সংশোধনীর রায় প্রকাশ হয়েছে। সে বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য না করলেই ভালো করতেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি জানেন প্রধান বিচারপতির কথা নিয়ে ঢালাওভাবে মতামত  দেওয়া কারো পক্ষে শোভা পায় না।এ বিষয়ে ড. শাহদীন মালিক বলেন, প্রধান বিচারপতি দ্বৈত শাসনের কথা বলেছেন। দ্বৈত শাসনে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা স্পষ্ট। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এসব বিষয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিমকোর্টের কাছেই থাকতে হবে। অবশ্য কোনো সরকারই অধস্তন আদালতের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চায় না, সেজন্যই দ্বৈত শাসন চালু থাকছে। আমাদের আশপাশের দেশে অনেক আগেই এ দ্বৈত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে। এফএইচ/জেডএ/এনএফ/পিআর

Advertisement