মতামত

নাটকের দৃশ্য বদল

আজ সকালে রোদ ওঠেনি। মেঘলা আকাশ। হেমন্তের মাঝামাঝি এ-রকম হওয়ার কথা নয়। আকাশ কি আমার মন পড়তে পেরেছে? কোনোভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই ঘর থেকে বেরোলাম। হাসপাতালে যাওয়ার চেনা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি। তবে রাস্তাটা অচেনা লাগছে। সবকিছু কেমন যেন অজানা। অফিসে ঢুকে খানিকক্ষণ ঝিম ধরে থাকলাম। মনটা এক ধরনের শূন্যতা আর অবসাদে ভরা। প্রথম রোগী একজন ৭০-এর কাছাকাছি মহিলা, লিজ। আমার পুরনো চেনা মানুষ, ইতালীয় বংশোদ্ভূত। সবসময়ই লিজ আমার জন্য মজার মজার ইটালিয়ান কেক বানিয়ে নিয়ে আসে। সে সবসময়ই আমার পরিবারের খবর নেয়। আমার দু’সন্তানই তার কেকের বিশাল ভক্ত। আগে শহরের মাঝখানেই থাকতো সে। প্রচুর অভিবাসী বাসাবাড়ি কিনেছে তার এলাকাতে। সে নিরিবিলি পছন্দ করে বলে বেশ দূরের একটা বড় খামারের মাঝে বাড়ি কিনেছে। তার ভালোমন্দের খবর নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল আলোচনা করলাম। যাওয়ার পথে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় সে বললো, ‘ডাক্তার, মনটা ভালো আজ। আমার ভোটটা কাজে লেগেছে। হিলারির খেল শেষ।’ আমি তাকে বললাম, ‘তোমার ট্রাম্পকে সমর্থনের কারণ কী?’ সে সোজাসাপ্টা বলে দিলো, ‘দেখো ডাক্তার, আমার স্বাস্থ্য বীমার জন্য অতিরিক্ত খরচ বাড়ছে। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে। আমার চারদিকে মানুষ বাড়ছে। ভিন্ন জাতের, ভিন্ন গোত্রের মানুষ। আমার মনে হয়, এ দেশ আর আমার নয়। আমি এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় চিন্তিত। আমার ছেলে আইওয়াতে থাকে। আট বছর আগে চাকরি হারানোর পর ও ভালো একটা চাকরি পায়নি। ট্রাম্প এ দেশকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাবে।’ তার ছেলের চাকরি ফিরে আসবে বলে তার দৃঢ়বিশ্বাস। দুপুরে খেতে যাওয়ার আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক, পার্কার সাহেব এলেন আমাকে দেখার জন্য। তিনি আমার অনেক পুরনো রোগী। খানিকটা বন্ধুর মতো। তাকে তার শরীরের ব্যাপারে আলোচনার পর সে নিজে থেকে আমাকে এবারের নির্বাচন সম্পর্কে তার মনোভাব জানালো। পার্কার সাহেব মনে করেন, ‘এ দেশের জনগণ এবারে প্রচলিত রাজনীতিবিদদের শিক্ষা দিয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, রাজনীতিবিদদের ওপর সাধারণ মানুষেরা ক্ষিপ্ত। সাধারণ অল্পশিক্ষিত জনগণ যারা সংখ্যাগুরু, তারা মনে করেন রাজনীতিবিদেরা কেউ কোনো কথা রাখেননি। তারা সবাই তাদের ভোট নিয়ে ওয়াশিংটনে  গেছেন এবং তাদের ভুলে গেছেন। তাই রাজনীতিবিদ নন এমন একজন, ট্রাম্পকে তারা অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছেন। সাধারণ অল্পশিক্ষিত জনগণ তার কথার মাঝে সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। তারা মনে করেন, এই ধনকুবের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ট্রাম্পই পারবে এ দেশকে মহান ও পরাক্রমশালী করতে।’ বিকেলে বাড়িতে ফেরার পথে কফি খাওয়ার জন্য ক্যাফেটেরিয়াতে বসেছি। আমার হাসপাতালের বড়কর্তা, পল সঙ্গে এসে বসলেন। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মনমতো প্রার্থী কি প্রেসিডেন্ট হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘তুমি কী বল?’ ও হেসে বললো, ‘এটাই গণতন্ত্র, বন্ধু। এজন্যই এ-দেশটি পৃথিবীর অন্যসব দেশের চেয়ে আলাদা।’ পলের বাবা আর্জেন্টিনা থেকে এ-দেশে এসেছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে। পল বললো, ‘সারা দুনিয়ার মানুষ আমাদের নিয়ে ভাবছে। তারা মনে করছে, এ দেশের মানুষ কীভাবে এ-রকম এক উদ্ভট নেতা পছন্দ করলো? এ দেশের মানুষের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সারা পৃথিবীর সবাই যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের নির্বাচনের ফল আশা করে, তা যে এ-দেশের মানুষের জন্য এক হবে এমন কোনো কথা নেই। তাছাড়াও প্রেসিডেন্টের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। অনেকেই জানে, সেগুলো বাস্তবে পরিণত করতে হলে তাকে কংগ্রেস, সিনেটের মাঝ দিয়ে রাজি করিয়ে নিতে হবে। তাই অনেকেই এবারে একটা সুযোগ নিয়েছে।’ অরাজনৈতিক এক একরোখা মানুষকে তারা বেছে নিয়েছে। বাসায় ফিরে দিঘির পাড়ে বসেছি। আমার প্রতিবেশী কার্ল এসে বসলো আমার সঙ্গে। ওর ভাবাবেগের কোনো পরিবর্তন নেই। ও বললো, ‘নির্বাচন তো একটা খেলা। এ খেলাতে জিততে হলে তো সবচেয়ে অভিজ্ঞতাপূর্ণ চৌকস হওয়ার দরকার নেই। এতে প্রার্থীর জানতে হবে, তার ভোটার কারা? তাদের খুশি করে ভোট নেয়ার জন্য কী করতে হবে? তাদের কীভাবে ভোটকেন্দ্রে আনা যাবে? নির্বাচনের আগে কী প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে- সেটা তো সবসময়ই উপেক্ষিত থেকে যায়।’ বলেই এক গাল হাসলো সে। আবার শুরু করলো সে, ‘এখন ও শহরের বাইরের কৃষ নির্ভর এলাকাগুলোতে অধিকাংশ ভোটার থাকে। তারা শ্বেতাঙ্গ, অল্পশিক্ষিত, অবহেলিত। ট্রাম্প তাদের ভাষায় কথা বলেছেন। তাদের তুলে এনেছেন নির্বাচনের আলোকিত মঞ্চে। এরাই নীরব বিপ্লব করে দিয়েছে।’ এবারের নির্বাচনের ফল নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি না। আমি এ দেশের একজন নিরপেক্ষ ভোটার। কোনো দলের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনীতি করি না। তবুও এ-বারের নির্বাচন নিয়ে বেশ কথা বলেছি, লিখেছি। এ-দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সাধারণ জনগণের এ ধরনের রাজনৈতিক বিদ্রোহ আগে হয়েছে কিনা- জানা নেই। আর রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভাঙার এ-ধরনের নজিরও কেউ দেখেছে বলে শুনিনি। এ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালে দু’দলেরই প্রার্থী আর সমর্থকদের মাঝে রাজনৈতিক হীনম্মন্যতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। আশা করবো, সে হীনম্মন্যতাগুলো আস্তে-ধীরে মিলিয়ে যাবে। এ-দেশের অর্থনীতি বা বৈদেশিক নীতিমালার তেমন পরিবর্তন হবে না বলে অনেকে মনে করেন। বেআইনি অধিবাসীদের অনেককে হয়তো এ-দেশ ছাড়তে হবে। তারা তো বলির পাঁঠা। সংখ্যালঘুরা সবসময়ই সহজ লক্ষ্য। সেটিও খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন না অনেকেই। সময় বলে দেবে সব। সময় বদলে দেয় সবকিছু। বন্ধু শত্রু হয়, আর শত্রু হয়ে যায় বন্ধু। সময় তো সব ক্ষতগুলো শুকিয়েও দেয়। আমরা সময়ের সঙ্গে দেখবো সেসব। কেবল নাটকের দৃশ্য বদল হচ্ছে।লেখক : পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিএইচআর/পিআর

Advertisement