সাহিত্য

হুমায়ূন আহমেদ : এক নন্দিত কথাশিল্পীর প্রতিকৃতি

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের  ৬৮তম জন্মদিন আজ। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তার সৃষ্টি সম্ভার।  ১৯৪৮ সালের আজকের এই দিনে হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। উপন্যাস, নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। উপন্যাসে ও নাটকে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোও আলোচনার বিষয়। ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠেছে ভীষণ জনপ্রিয় ও অনুসরণীয়।২০১১ সালের  দিকে তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান তিনি। বেশ কিছুদিন চিকিৎসা চলার এক পর্যায়ে দেশেও ফিরে আসেন। পরে আবার চিকিৎসা নিতে যান নিউইয়র্কে। সেখানে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৪ জুন তাকে সমাহিত করা হয় তারই গড়ে তোলা নন্দনকানন নূহাশ পল্লির লিচুতলায়।বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। সত্তর দশকের শেষভাগে থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। এই কালপর্বে তার গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তার সৃষ্ট হিমু এবং মিসির আলি ও শুভ্র চরিত্রগুলো বাংলাদেশের যুবক শ্রেণিকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও তার সৃষ্টিকর্মের অন্তর্গত। ধরা হয় বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনপ্রিয়তা তিনি শুরু করেন। তার রচিত প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তবে তার টেলিভিশন নাটকগুলো ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। সংখ্যায় বেশি না হলেও তার রচিত গানগুলোও সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার অন্যতম উপন্যাস হলো নন্দিত নরকে, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া ইত্যাদি। তার নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, ঘেঁটুপুত্র কমলা ইত্যাদি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন। লেখালিখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে আটক করে এবং নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালায়। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। বাবা ফয়জুর রহমান ছিলেন পুলিশ অফিসার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। হুমায়ূন আহমেদ নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১) ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ (১৯৯৩ ও ১৯৯৪) আরো অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। জাপান টেলিভিশন ‘এনএইচকে’ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছে ১৫ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘হু ইজ হু ইন এশিয়া’।হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে আজ সারাদিন ধরেই নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। টিভিতে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। দিনটি উপলক্ষে চ্যানেল আই চেতনা চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে ‘৫ম হিমু মেলা’। নূহাশ পল্লিতে থাকছে বিশেষ অনুষ্ঠান। কানাডার টরেন্টোতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের একক বই মেলা। জন্মদিনে এই কথাশিল্পীর প্রতি রইলো আমাদের শ্রদ্ধা। এইচআর/এমএস

Advertisement