মতামত

বৈদেশিক বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশ

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাদের উন্নতির পেছনে অন্যতম কারণ বিদেশি বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ একে অন্যের পরিপূরক। বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ। বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করেছে চীন ও ভারত। ২০১৪ সালে দেশে নিট বিনিয়োগ ছিলো ১৫৫ কোটি ১২ লাখ ডলার, ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২৩ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে। অবশ্যই আশাব্যঞ্জক একটা দিক। তবে ক্রমাগত উন্নয়নের পথে চলমান বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে। এই দেশে বিনিয়োগে মুনাফার পরিমাণ অনেক বেশি। একইসঙ্গে ঝুঁকি প্রায় শূন্যের কোঠায়।বাংলাদেশের ভূগর্ভে রয়েছে তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুদ। পেট্রোবাংলার দেয়া তথ্য মতে, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ রয়েছে আট ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। বর্তমানে বার্ষিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এই গ্যাস দিয়ে চলবে আট থেকে নয় বছর। তবে দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রে সম্ভাব্য মোট মজুদের পরিমাণ ২৭ দশমিক ১২ টিসিএফ গ্যাস। এর মধ্যে প্রায় ১৪ টিসিএফ গ্যাস তোলা হয়েছে। ১৩ টিসিএফ গ্যাস এখনও মজুদ আছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরো বেড়ে গেছে। সাগর ও দেশের স্থলভাগে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ভোলার শাহবাজপুর, পাবনার মোবারকপুর, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা, সিলেটের ছাতকের পূর্ব অংশে বড় গ্যাস কাঠামোর সন্ধান মিলতে পারে। এদিকে সাগরে ভারত ও মিয়ানমার অংশে যেহেতু তেল-গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশ অংশেও তেল-গ্যাস পাওয়া যাবে, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। মিয়ানমার এরই মধ্যে গ্যাস রপ্তানি শুরু করেছে। এই ক্ষেত্রে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এ খাত আজ বিপুল সম্ভাবনাময়।বিশ্বে পর্যটন এখন সবচেয়ে লাভজনক এবং গতিশীল খাত। পর্যটন এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যেখানে প্রচুর বিনিয়োগ না করেই বিপুল আয় করা সম্ভব। পর্যটনের জন্য তেমন কিছু সৃষ্টি করতে হয় না। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণকে রূপান্তরের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলেই চলে। পর্যটন স্পটগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এ খাত থেকে বিপুল আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য দর্শনীয় বস্তুর অভাব নেই। এদেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যুগে যুগে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন দেশে পর্যটন খাতে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো, উন্নত করা হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় বহু পর্যটক ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করে বাংলাদেশে না এসে চলে যায় ভুটান কিংবা নেপালে। সরকার পর্যটনকে শিল্পখাতের মর্যাদা দিয়ে এক অধিকারপ্রাপ্ত খাতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে এ খাত বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনার খাতে পরিণত হয়েছে।বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বৃহৎ অংশ আসে পোশাক খাত থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এ দেশের তৈরি পোশাকের বিপুল চাহিদা রয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। আলোচ্য বছরে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারে। মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশ আয় এসেছে পোশাক খাত থেকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর খাতটির রপ্তানির আয়ের পরিমাণ ২ হাজার ৮০৯ কোটি ৪১ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই আয় গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের চেয়ে ১০.১৪ শতাংশ বেশি এবং আলোচ্য সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২.৫৮ শতাংশ বেশি। কোটামুক্ত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ স্থাপন। সে কারণেই আমাদের দেশে পোশাক খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের জয়েন্ট ভেঞ্চারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে।কৃষি দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৫৫ ভাগ কোনো না কোনোভাবে কৃষিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক এবং একটি সম্ভাবনাময় বৃহৎ বাজার। আমাদের জিডিপিতে কৃষির বর্তমান অবদান শতকরা ১৬ ভাগ। কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উপখাত হলো শস্য খাত, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৯.৫৬ ভাগ  জোগান দেয়। মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং বন উপখাতের অংশ যথাক্রমে শতকরা ১০.৩৩, ১০.১১ এবং ১০.০০ ভাগ। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এক বিপুল সম্ভাবনাময় খাত। তাছাড়া উন্নত ফলনশীল বীজ উৎপাদন, সবজি প্রক্রিয়াকরণ, ফল সংরক্ষণসহ বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের প্রবেশের বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।সরকার  এরই মধ্যে বেসরকারি খাতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল গড়ে তোলার অনুমতি দিয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে বিদেশি কোম্পানি প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের ইপিজেড এলাকায় শিল্প পার্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।দেশের অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখন যে কোনো কোম্পানির জন্য সরকার বিল্ট অপারেট এন্ড ওন (বিওও), বিল্ট অপারেট এন্ড ট্যান্সফার (বিওটি) মডেলের অনুসরণে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেতু, টানেল, বন্দর অবকাঠামোর উন্নয়ন, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিল্প পার্ক নির্মাণ প্রভৃতি খাত বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক নীতিগুলোর ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করেছে। নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধকে ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। সরকার সুষম গতিতে বাণিজ্য ক্ষেত্রে উদারীকরণ করেছে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ এবং রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধিত হয়েছে। শিল্পহার কাঠামো ও আমদানি নীতির বিভিন্ন দিক সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ অন্যান্য দেশের সরকার এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিনিয়োগের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে ‘গুডউইল অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে কাজ করতে পারেন সেজন্য যে দেশের উচ্চ পর্যায় থেকে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। আমাদেরও পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।riazul.haque02@gmail.comএইচআর/পিআর

Advertisement