মতামত

২৭ শর্তের বেড়াজালে বন্দি গণতন্ত্র!

আজ ১০ নভেম্বর। ১৯৮৭ সালের এই দিনে দেশ উত্তাল ছিল স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে। আমি তখন কলেজের ছাত্র, থাকি কুমিল্লায়। সেই উত্তাল সময়ে রাজপথে থাকার উত্তাপটুকু টের পাই এখনো। সেদিন জীবন্ত পোস্টার হয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন নূর হোসেন। খালি গা নূর হোসেনের বুকে লেখা ছিল `স্বৈরাচার নীপাত যাক`, পিঠে লেখা ছিল `গণতন্ত্র মুক্তি পাক`। এত সহজ টার্গেট। পুলিশ মিস করেনি। নূর হোসেন জীবন দিয়ে যে আন্দোলনে গতি আনলো, সে আন্দোলনেই ৯০ এর ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদের।কিন্তু নূর হোসেনের আত্মদানের ২৯ বছর পরও স্বৈরাচার নিপাত যায়নি। বরং পতিত স্বৈরাচার এরশাদ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা প্রধান দুই দলের সঙ্গে জোট করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে জায়েজ করে নিয়েছেন। এরশাদ আজ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তার দল অবশ্য সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে। আর গণতন্ত্র এখন ২৭ শর্তের বেড়াজালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিটিউশন বা প্রেসক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বন্দি।বিএনপি ৭ নভেম্বর পালন করে `জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস` হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিএনপির জন্ম না হলেও সেদিনই আসলে তাদের আদর্শিক জন্ম। ৭ নভেম্বর নিয়ে বিএনপির অবস্থানের সাথে আমার প্রবল ভিন্নমত। তবুও আমি চাই তারা তাদের মতটা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করুক। ৭ নভেম্বর উপলক্ষে বিএনপি ৭ বা ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে না হলে অন্তত নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে। কিন্তু কোনোটারই অনুমোদন পায়নি তারা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়ে দিয়েছে রাস্তা আটকে সমাবেশ করা যাবে না। তবে পুলিশ ৮ নভেম্বর অনুমতি দিয়েছিল। নয়াপল্টনে নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তো নয়ই, এমনকি সমাবেশও নয়; পুলিশ বিএনপিকে আলোচনা সভা করার অনুমতি দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টটিউশনের ভেতরে। সঙ্গে ২৭ শর্তের বেড়াজাল। শর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করে লেখার কলেবর বাড়াতে চাই না। তবে দুপুর ১টায় অনুমতি দিয়ে সাড়ে ৪টার মধ্যে শেষ করতে বলাকে ফাজলামো ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে সরকার বিরোধী দলকে আর রাজপথে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেবে না। বাংলাদেশের জন্মের আগে পরে সবচেয়ে বেশি সময় রাজপথে কাটানো আওয়ামী লীগ কেন হঠাৎ এমন রাজনীতিবিমুখ হয়ে গেল বোঝা মুশকিল। আওয়ামী লীগ কখনো বিরোধী দলে গেলে নিজেদের রাজপথ থেকে দূরে রাখতে পারবে তো? নাকি আওয়ামী লীগ কখনো বিরোধী দলে যাবেই না? আমরা আগেও দেখেছি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে হরতাল, জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরোধিতা করেছে; কিন্তু বিরোধী দলে গিয়ে নিজেরা বারবার তাই করেছে। আমি নিজেও স্বৈরাচাররবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলাম। তবুও আমি চাই না, আবার কখনো বাংলাদেশে সেই হরতাল-অবরোধ-পেট্রোল বোমা-ভাঙচুরের দুঃসহ দিন ফিরে আসুক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এখন যেই গতিতে উন্নয়নের পথে, অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে; আমিও চাই না সেই গতি রুদ্ধ হোক। কিন্তু রাজনীতির মাঠটা তো সবার জন্য সমান হতে হবে, তাই না? আওয়ামী লীগ দুদিন ধরে শুধু রাস্তা নয়, ঢাকা শহরের বিরাট অংশ অবরুদ্ধ করে কাউন্সিল করতে পারবে, আর বিএনপিকে এক বেলার জন্য সমাবেশ করতে দেয়া হবে না, এ কেমন কথা। এর দায় কিছুটা বিএনপিকে নিতে হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং ২০১৫ সালে এই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিএনপি আন্দোলনের নামে যা করেছে, তা দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে বহুদিন। আন্দোলনের নামে এই নাশকতাকে অজুহাত করেই সরকার এখন বিএনপিকে মাঠে নামতে দেয় না। অবশ্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, `আমাদের আন্দোলন গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক। সবচেয়ে কম ক্ষয়ক্ষতিতে সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জনই আমাদের কৌশল। আর আন্দোলন বলতে আমরা পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ বুঝি না। জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাসে আমরা বিশ্বাস করি না। যদিও আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্যাবোটাজ করতে প্রতিপক্ষ আমাদের কর্মসূচি চলাকালে বিভিন্ন নাশকতা করে আমাদের ওপর দায় চাপাতে চায়।` যদি খালেদা জিয়ার দাবি সত্য বলে মনে করি, এই স্যাবোটাজ ঠেকানোর উদ্যোগ নিলেন না কেন তিনি? কেন অবরোধকে ৯২ দিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে মানুষকে পুড়ে মরতে দিলেন? অবরোধ তুলে নেয়ার সাথে সাথেই তো বেগম জিয়ার ভাষায় `স্যাবোটাজ` বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে এটা ঠিক বিএনপি এখন সেই নাশকতার আন্দোলন থেকে সরে এসেছে। কিন্তু সরকার যদি ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের নাশকতার দায়ে ২০১৬ সালের নভেম্বরেও বিএনপিকে রাস্তায় নামতে না দেয়; তাহলে আওয়ামী লীগও ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর লগি বৈঠার নাশকতার দায় এড়াতে পারবে না। অবশ্যই অতীতের অপরাধের বিচার হবে, কিন্তু অতীতের দায়ে সারাজীবন বিএনপির সব গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া ঠিক নয়। ব্যাপারটা যদি এমন হয়, এখন থেকে কেউ আর রাজপথে সভা-সমাবেশ-মিছিল-ভাঙচুর-নাশকতা করবে না; তাহলে সেটা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। আর সেটা ঠিক করতে হবে বড় দলগুলো একসাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে। একদল কাউন্সিল করবে, আরেক দল সমাবেশ করতে পারবে না; তা হবে না, তা হবে না।সরকারের অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করতে না পারলে, বিএনপিকে আমরা বলি অথর্ব। জ্বালাও-পোড়াও করলে বলি অগণতান্ত্রিক। বিএনপি যাবেটা কোথায়? বিএনপির যাওয়ার অনেক জায়গা আছে। কিন্তু বিএনপি সেখানে যায় না। বিএনপি তাদের রাজনীতিকে বন্দি করে ফেলেছে প্রেসক্লাব আর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে। কেন তারা নাসিরনগর যায়নি? কেন দিনাজপুরের ধর্ষিতা পাঁচ বছরের শিশুর পাশে দাঁড়ায়নি? কেন খাদিজার পাশে দাঁড়ায়নি? এমন হাজার প্রশ্ন আছে, যার কোনো উত্তর নেই।বিএনপি আগামী ১৩ নভেম্বর আবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছে। আশা করি এবার সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। নূর হোসেনরা যে চেতনায় জীবন দিয়েছিল, সেই গণতান্ত্রিক চেতনার পথ ধরেই সমৃদ্ধির শিখরের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। শুধু দিবস উদযাপনের আড়ম্বরে যেন হারিয়ে না যায়, আমাদের সংগ্রামী অতীতের চেতনা।এইচআর/পিআর

Advertisement