মতামত

ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনদের জয়

অ্যাজ আ ফেমিনিস্ট ইউ মে সাপোর্ট হিলারি ক্লিনটন ইন দ্যা আপ কামিং ইলেকশন- এক মার্কিন বন্ধুর এমন মন্তব্যে, রীতিমতো বিরক্তই হয়েছিলাম আমি। বোঝাতে চাই তাকে, আমাকে নারীবাদী তকমা দিয়ে ভুল করছো। আমি মানুষকে, মানুষ হিসেবে দেখি। নারী বা পুরুষ নয়, লিঙ্গ আমার কাছে কখনও প্রাধান্য পায় না, পাবেও না কখনও। মানুষ হিসেবে মানুষের মেধা, যোগ্যতা, জ্ঞান, উদারতা, মানবিকতাই বিচার্য। অশোভন আচরণ আমার কাছে কখনোই প্রশ্রয় পায়নি। অন্যের প্রতি সম্মান, সম্ভ্রমবোধ গুরুত্ব দিয়েছি বরাবরই। এর সঙ্গে নারী-পুরুষের কোনো সম্পর্ক নেই। ট্রাম্পকে মার্কিন নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ ও মিডিয়া যে পরিমাণ অপদস্থ, বিষোদ্গার ও হয়রানি করেছে তাতে হিলারি নয়, ট্রাম্পকেই সমর্থন করবো আমি। বন্ধুটি ডেমোক্রেট দলের সমর্থক ঢের বুঝতে পারি। বন্ধুকে কতোখানি বোঝাতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছে সে, জানি না। হয়তো আমি সফল বা ব্যর্থ, তার চেহারা দেখে অবশ্য কোনোটাই অনুবাদ করতে পারি না আমি। কট্টরপন্থী, রক্ষণশীল সমর্থকদের এ এক সমস্যা। যুক্তির চেয়ে অন্ধত্বই তাদের মধ্যে বেশি। ট্রাম্পের বিজয়ে, হিলারির পরাজয়ে আমার বন্ধুর মতো অনেক রক্ষণশীলেরাই অখুশি নিশ্চয়ই। যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে ভাবেন, উদার বলে প্রচার করেন কিন্তু ভেতরে তার লেশমাত্র নেই।ট্রাম্পের বিজয়ে বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন, হিলারি জয়লাভ করবেন। বিশেষ করে মার্কিন মিডিয়া রীতিমতো অন্যায় আচরণ করে আসছিল ট্রাম্পের প্রতি। ট্রাম্প সে কথা বার বার বলেও আসছিলেন, চিৎকার করছিলেন, করছিলেন প্রতিবাদ। কে শোনে কার কথা। অবশেষে ট্রাম্প নিজেই নিরপেক্ষ প্রচার পাওয়ার প্রত্যাশায়, ‘ট্রাম্পটিভি’ খোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। প্রথম সারির অনেক মার্কিন ম্যাগাজিনই হিলারির হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে ‘কাভারপেইজ’ তৈরি করে রেখেছিলেন। তৈরি হয়েছিল অনেক বিশ্লেষকদের কলাম, যদিও সেসব কিছুই কাজে লাগেনি। জনস্রোতে, ট্রাম্প-প্লাবণে ভেসে গেছে সবই। শুরু থেকেই ট্রাম্প নিজের প্রচার করেছেন যতোখানি, অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। অনেক বেশি প্রত্যয়ী ছিলেন বলেই বলেছিলেন, নির্বাচনে হারলে ফল মানবো না। বোঝা যায়, কতবেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কম ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, ভ্রুকুটির শিকার হননি। সবচেয়ে অশ্লীল রকমের মারাত্মক যে অস্ত্রটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল- তা যৌনতা, যৌন হয়রানির অভিযোগ। পশ্চিমের অনেক দেশেই বিশেষ সময়ে এই ‘বিশেষ অস্ত্রটি’ ব্যবহৃত হয়ে থাকে পুরুষের বিরুদ্ধে। যদিও অভিযোগটি করা সহজ, প্রমাণ করা কঠিন। জেসিকা লিডসে প্রথম যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন; বলেন, ট্রাম্প একবার এক উড়োজাহাজে জড়িয়ে ধরে চুমু খান তাকে। তারপর সামার জাভোর্স। যিনি একসময়ে ট্রাম্পের রিয়েলিটি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’-এর প্রতিযোগী ছিলেন। অভিযোগ করেন, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি হোটেলে ট্রাম্প তাকে ডেকে নিয়ে জোর করে চুমু খেতে চেয়েছিলেন। ট্র্যাপ করেছিলো ট্রাম্প তাকে- অমন তার অভিযোগ। তালিকায় আরও যোগ হয় সাবেক মডেল ক্রিস্টিন অ্যান্ডারসন, সাবেক মিস ইউনিভার্স এ্যালিসিয়া মাসাদোসহ আরও কয়েকজনের নাম। ট্রাম্পবিরোধীরা সেসব অভিযোগকে কাজে লাগানোর চূড়ান্ত চেষ্টাটিও করেন। যদিও শেষাবধি সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় তার বিরুদ্ধে। ট্রাম্প খুব চমকপ্রদ মানুষ। ৭০ বছর বয়সেও সতেজ, কর্মোদ্দীপ্ত। ম্যাড়ম্যাড়ে নন মোটেও। প্রায় আরো দু’মাস আগে তিনি প্রথম ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনার একটি ধারণাপত্র জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন। মার্কিনিদের ভালোবাসেন বলেই অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার, হোয়াইট হাউসভিত্তিক তদবিরবাজদের জন্য তিনি মূর্তিমান আতঙ্ক। বিজয় ভাষণে বলেছেন, আমেরিকানদের নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। নতুন এক উচ্চতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে চান আমেরিকানদের। কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য, বক্তব্য তিনি দেননি। ট্রাম্প ভার্সেটাইল মানুষ। বহু গুণ, বহু যোগ্যতা তার। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার এই মানুষটি যোগ্যতা রাখেন ১০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। যার সম্পদের পরিমাণ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে রয়েছে ৭২ তলা ট্রাম্প ওয়ার্ল্ড টাওয়ার, সেটিও নিজেই গড়ে তুলেছেন তিনিই। বাকপটু, উপস্থাপনায়ও অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে তার। এনবিসি টেলিভিশনে রিয়েলিটি শো ‘দ্য এ্যাপ্রেনটিস’ তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলো। মিস ইউনিভার্স আয়োজিত হয় তারই প্রতিষ্ঠান থেকে, সেখান থেকেই মিস ইউএসএ’র শুরু। যারা রেসলিং পছন্দ করেন, তাদের রেসলিংয়ের আঙিনায় ট্রাম্পের উপস্থিতি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সবচেয়ে বড় যোগ্যতা তিনি জনগণের পালস বোঝেন, যিনি মার্কিন জনগণের ভালোবাসা আদায় করে নিতে পেরেছেন। যিনি জয়ী হতে পেরেছেন হিলারির মতো চতুর আর কৌঁসুলি রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে। মার্কিন এই নির্বাচন, ট্রাম্প-হিলারির প্রতিযোগিতা জীবনের একটি গভীরতম সত্য, বোধেরও ইঙ্গিত দেয়। মানুষ হারতে হারতে জিতে যায়, জিততে জিততে হেরে যায়। জীবন আসলে এমনই। এক ভাবে, হয় আরেক জীবনে। মহা প্রতাপশালী, ক্ষমতাবান সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কী কখনো ভেবেছিলেন, হেরে যাবেন তিনি? ই-মেইল তদন্ত আর উইকিলিকস-ই হিলারিকে খাদের কিনারায় নিয়ে দাঁড় করায়। যুদ্ধ ও জঙ্গিবাদে পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। মানুষ পরিবর্তন চায়। প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার প্রতি মার্কিন জনগণ আস্থাশীল নয়। অস্বীকারের সুযোগ নেই এখন আর কোনো। পেশাদার রাজনীতিবিদদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষ। তাদের হৃদয় নেই, তারা শুধুই ক্ষমতাবান। ট্রাম্প রাজনীতির বাইরের, তার হয়তো একটি হৃদয় আছে। সেটি ভেবেই, সাধারণ মার্কিন মানুষ ভোট দিয়েছে ট্রাম্পকে। সাধারণ মানুষ, অক্ষমতাবানদের ভোটে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে অক্ষমতাবানদের বিজয়। আমি নিজেও বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী। ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে সবসময় মানুষের হৃদয়ে পৌঁছা যায় না, স্পর্শ করা যায় না মানুষকে। ট্রাম্পের এই বিজয় আর সবাইকে বিস্মিত করলেও, আমাকে করেনি মোটেও। কেননা আমি বিশ্বাস করি, মানুষের ভালোবাসায়। সেই ভালোবাসার শক্তি, ক্ষমতাই বিজয়ী করেছে ট্রাম্পকে। জয় ট্রাম্প। অভিনন্দন ডোনাল্ড ট্রাম্প। লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।এইচআর/এবিএস

Advertisement