দেশজুড়ে

অসহায় বৃদ্ধাদের কল্যাণে দৃষ্টান্ত ফটো আপা

সুলতানা শামীমারা বেগম। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। ইচ্ছে ছিলো চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করার। কিন্তু সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। জড়িয়ে পড়েন শিক্ষকতা পেশায়। পেশা শিক্ষকতা হলেও ছুটে চলেন এলাকার দরিদ্র ও অসহায় বৃদ্ধা নারীদের কল্যাণে। গত ৯ বছরে তিনি প্রায় ১০০ জন বৃদ্ধা নারীর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। শুধু তাই নয়, শামীমারা বেগম নিজের টাকায় ২০১৩ সালে গড়ে তোলেন একটি বৃদ্ধাশ্রম। ১১ শতক জমির ওপর প্রায় ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে টয়লেটসহ ২২ হাত আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেন। বৃদ্ধাশ্রমটি তিনি তার বাবা ডা. শামছুজ্জোহা সরকারের নামে  ‘শামছুজ্জোহা মেমোরিয়াল বৃদ্ধাশ্রম’ নামকরণ করেন। তবে অর্থ সংকটের কারণে এটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।  এছাড়া শামীমারা বেগম বৃদ্ধা নারীদের সহায়তার পাশাপাশি এলাকার বাল্যবিয়ে রোধ, গ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা পালন করছেন। এসব সামাজিক কাজের জন্য এরই মধ্যে তিনি জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৩টি পুরস্কার অর্জন করেছেন। সুলতানা শামীমারা বেগম ফটোর বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা সদর ইউনিয়নের কচুয়াহাট গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের ডা. শামছুজ্জোহা সরকারের মেয়ে। তিনি ১৯৮০ সালে এসএসসি, ১৯৮২ সালে এইচএসসি ও ২০১২ সালে স্নাতক পাস করেন। ১৯৮৬ সালে আবদুর রাজ্জাক মণ্ডলকে বিয়ে করেন সুলতানা শামীমারা। স্বামী আবদুর রাজ্জাক সাঘাটা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। বিয়ের সাত দিন পর সুলতানা শামীমারা কচুয়াহাট শহীদ এইচআরএম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দাম্পত্য জীবনে এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে তার। এর মধ্যে বড় মেয়ে রাজসি সুলতানা অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং ছেলে জারিফ রাজ অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বিয়ের পর স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো দিন কাটতো তার। এরপর তিনি এলাকার অসহায় বৃদ্ধা নারীদের সহায়তার কথা ভাবতে থাকেন। পরে গত নয় বছর আগে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ছুটতে থাকেন এলাকার অসহায় বৃদ্ধা নারীদের কাছে। শুরু করেন বৃদ্ধা নারীদের কল্যাণে কাজ। ফটো আপা মূলত প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হতেন। এরপর পাড়া-মহল্লায় গিয়ে অসহায় বৃদ্ধাদের খোঁজখবর নিতেন। তারপর যার যেমন সমস্যা ও চাহিদা, ঠিক সে অনুযায়ী অল্প সময়ে সমাধান করে দিতেন। বিশেষ করে যাদের স্বামী নেই, ছেলেমেয়েরা ভাত-কাপড় দেন না, থাকার জায়গা নেই, এমন বৃদ্ধাদের চিকিৎসায় নিজের টাকায় ওষুধ কিনে দেন তিনি। এছাড়া ফটো আপা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের অনুরোধ করে এলাকার অসহায়দের বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি কার্ড করার ব্যবস্থা করে দিতেন। ২০০৭ থেকে চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় এলাকার ১০০ জন বৃদ্ধাকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করেছেন তিনি। ফলে এসব অসহায় বৃদ্ধা নারী এখন আর মানবেতর জীবন-যাপন করেন না। এদিকে, এসব অসহায় বৃদ্ধ নারীদের সহায়তা দেয়ার পর তারা কেমন আছেন, তা তদারকি করতে বৃদ্ধাদের সঙ্গে সাপ্তাহিক বৈঠকে মিলিত হন ফটো আপা। সপ্তাহে একদিন সুবিধা পাওয়া বৃদ্ধাদের নিয়ে বৈঠক করে তাদের সুখ-দুঃখের কথা শোনেন তিনি।  এরই মধ্যে ফটো আপার সহায়তায় উপকৃত হয়েছেন- কচুয়াহাট গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৬৪), একই গ্রামের আছিয়া বেগম (৭০) ও কস্তুরি বেগম (৭২)। তারা বলেন, ‘সোয়ামি (স্বামী) ও ব্যাটা (ছেলে) থাকলেও মানসের বাড়িত কাম করি সংসার চালাই। হামার দুকের (দুঃখ) কতা শুনি ফটো আপা বিদুবা (বিধবা) ভাতার কার্ড করি দিচে। এখন হামরা অনেক ভালো আছি।’সুলতানা শামীমারা বেগম ফটো বলেন, আমার কলেজ শিক্ষক স্বামীর টাকায় সংসার চলে। আর নিজের বেতনের টাকা বৃদ্ধা নারীদের পেছনে ব্যয় করছি। এছাড়া নিজের টাকায় বাড়ির পার্শ্ববর্তী ধনারুহা গ্রামে ১১ শতক জমি কিনেছি ওই জমিতে প্রায় ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে টয়লেটসহ ২২ হাত আধাপাকা ঘর নির্মাণ করে বাবার নামে ‘ডা. শামছুজ্জোহা মেমোরিয়াল বৃদ্ধাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেছি।তিনি আরও বলেন, ‘বয়স বেশি হলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। পরিবারের কাছে অনেকটা অবহেলিতও হন। তাই বৃদ্ধাদের জন্য কাজ করছি। ভবিষ্যতে বৃদ্ধা নারীদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছি না।’  এ বিষয়ে জানতে চাইলে কচুয়াহাট গ্রামের ইউপি সদস্য মজদার রহমান বলেন, ‘ফটো আপা নিরলসভাবে এলাকার বৃদ্ধা নারীদের সহায়তা করে আসছেন। যে কাজ জনপ্রতিনিধির করার কথা, সে কাজ ফটো আপা করছেন। এজন্য আমরা সব সময় তাকে উৎসাহ দেই।’ সাঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অসহায় বৃদ্ধাদের জন্য সুলতানা শামীমারা ফটো দৃষ্টান্ত। তার প্রচেষ্টায় এলাকার অনেক অসহায় বৃদ্ধারা উপকৃত হচ্ছেন। তাকে অনুপ্রেরণা যোগানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।’ জিল্লুর রহমান পলাশ/আরএআর/এমএস

Advertisement