প্রচারণার অভাব, বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকা, রেডিও, টিভি ও মোবাইল প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল থাকার কারণে এখনো দুর্যোগের পূর্বাভাস ঠিক মতো পায় না ভোলার উপকূলের বাসিন্দারা। এসব উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগের সতর্কবার্তা পৌঁছায় না। ফলে আবহাওয়া অধিদফতর থেকে কখন কী সতর্কবার্তা জারি করা হয় তা সম্পর্কে জানে না উপকূলবাসী। উপকূলবাসীর অভিযোগ, দুর্যোগকালীন সময়ে জেলা শহরে প্রচারণা চালানো হলেও দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছে না। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় ঠিক মতো প্রচারণাও চালানো হয় না। যে কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উপকূলের বাসিন্দারা।সোমবার বিকেলে ভোলার লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলার বাঁধসহ বিভিন্ন রিমোর্ট এলাকা ঘুরে উকপূলবাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।উপকূলের বাসিন্দারা জানান, গত কয়েক বছরে সিডর, আইলা, রেশমি, রোয়ানু ও মহাসেনসহ বিভিন্ন ঝড় তাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। কিন্তু কোনো ধরনের পূর্বাভাস পাননি তারা। এছাড়া উপকূলে থাকায় এসব ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে তাদের কেউ সতর্ক করেনি। ফলে ওই ঝড়ে তাদের জানমালের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আজও উপকূলবাসী অরক্ষিত। দুর্যোগ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও ফের দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। এর মধ্যে অনেক দুর্যোগ আসে যায়। কিন্তু তাদের কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছায় না।দুর্যোগের আগে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, দুর্যোগ প্রতিরোধ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা সতর্কবার্তা পৌঁছানের দায়িত্বে থাকলেও ওসব কর্মী রিমোর্ট এলাকায় মাইকিং করছে না। এতে উপকূলের বাসিন্দাদের কাছে কোনো ধরনের সতর্কবার্তা পৌঁছে না। লালমোহনের ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের বাঁধ এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল, বাশার, ছিদ্দিক ও কাসেমসহ অন্যরা জানান, দুর্যোগকালীন সময়ে গত তিন বছর ধরে উপকূলে কোনো সতর্কবার্তা আসেনি। তাই মানুষজন আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারে না। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ ৭ নম্বর সতর্কবার্তা দিয়ে গেলেও সেটি পৌঁছায়নি তাদের কাছে। তবে জেলা সদরে মাইকিং করায় তারা এ বিষয়ে অবগত হয়েছেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, যদি কোমেন আঘাত হানতো, তাহলে বহু জানমালের ক্ষতি হতো। এসবের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোই দায়ী।গতকাল রবি ও সোমবার উপকূলে যখন নাডা আতঙ্ক ঠিক তখনই উপকূল ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধের ওপর অস্বাভাবিক জোয়ার বইছে। ঝড়ো বাতাসে তছনছ হয়ে গেছে পুরো এলাকা। তবুও বাঁধের মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড অনেকটা স্বাভাবিক। তবে বৈরী আবহাওয়া কিংবা ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস আকাশের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারেন তারা।বাঁধের পাশের বাসিন্দা রিজিয়া, আ. খালেক, মতিউর বলেন, কালকে ঝড় হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝড়ো বাতাস বইছে। এতে বুঝতে পেরেছি বড় ধরনের কোন দুর্যোগ আসবে। তাই কিছুটা সতর্ক আছি। ৪ নম্বর হুশিয়ারি সংকেত ও ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে বিবি রহিমা, লাইজু ও রেহানাসহ অনেক জেলে বধূর জানা নেই। তারা বলেন, নির্বাচন এলে মেম্বার-চেয়ারম্যান ভোট চাইতে আসে। কিন্তু দুর্যোগের সময় আমাদের কোনো খোঁজ-খবর নেয় না। দুর্যোগের পরেও আসে না। সিগন্যাল কি জানি না। আকাশের অবস্থা দেখে বুঝতে পারি কিছু একটা হবে। জেলার রিমোর্ট এলাকার মধ্যে মদনপুর, নেয়ামতপুর, চর কচুয়াখালী, রামদাসপুর, কলাতলী, চর নিজাম, চর জহির উদ্দিন, হাজিপুর, চর পাতিলা, ঢালচর, কুকরি-মুকরি, ঢালচর, চর মোজাম্মেল, সোনার চর অন্যতম। কিন্তু এসব এলাকার অধিকাংশ জনপদে সতর্কবার্তা পৌঁছায় না। এছাড়াও মূল ভূ-খণ্ডের বাঁধের ভেতর ও বাইরের এলাকার মানুষও ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উপকূলবাসীর। তবে সদরের তুলাতলীতে ব্যাপক প্রচারণা করতে দেখা গেছে স্বেচ্চাসেবীদের।লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাসেম বলেন, পুরো এলাকা মানুষ অনিরাপদ। কারণ এখনো তাদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়নি। তাই মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সরেজমিন ঘুরে উপকূলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব কাছ থেকেই উপকূলের ছোট বড়-বড় অসংখ্য ঝড় দেখেছেন তারা। ৭০’র ঘূর্ণিঝড় গোর্কি, ৯১’র সাইক্লোন তার মধ্যে অন্যতম। ওসব ঝড়ের পরেই সিডর ও আইলা ছিল ভয়ংকর। নদীর তীরের পরিবেশ, বাতাসের গতিবেগ, আকাশের অবস্থা দেখেই তারা বুঝতে পারেন ঝড় হবে। কিন্তু রেডিও, টিভি, প্রচারণা তাদের কাছে পৌঁছায় না। ভোলার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মাহামুদুর রহমান বলেন, ঝড় মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ৮টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়েও প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে মানুষকে।এ ব্যাপারে ভোলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপ-পরিচালক সাহাবুদ্দিন জানান, যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই উপকূলের বাসিন্দা। তারা ওসব এলাকা ঘুরে যথা সময়ে সতর্কা বার্তা পৌঁছে দেন। তবে উপকূলের কিছু জায়গা থাকতে পারে যেখানে হয়তো বার্তা পৌঁছাতে দেরি হয়। এএম/পিআর
Advertisement