জাগো উপকূল

সকালে ছাত্র, বিকেলে জেলে

সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায় রাসেল। দুপুরে ফিরে তাকেই আবার বৈঠা হাতে বসতে হয় মাছধরা নৌকায়। নিজের অদম্য ইচ্ছায় বাবা স্কুলে ভর্তি করালেও ক্লাসের পুরো কাজ শেষ করতে পারে না সে। স্কুলে বই-কলম নিয়ে যাওয়া-আসা ছাড়া কিছুই শিখতে পারে না। কারণ, শেখার মূল্যবান সময়ে তাকে থাকতে হয় পরিবারের অর্থ জোগানে।শুধু রাসেল একাই নয়, একই অবস্থা ফারুক, রিয়াজ, আরীফ, সোহেল ও মিঠুনসহ অনেকের। তাদের সবার বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের রেহানিয়া গ্রামে। স্কুল শেষ করে সবাইকে ফিরতে হয় মাছ ধরা নৌকায়। এমন চিত্র পুরো উপকূলের জেলেপাড়ার।শৈশবের পুরোটাই যেখানে বই-খাতা, স্কুল আর খেলাধুলায় কাটানোর কথা, সেখানে তারা এখন ব্যস্ত জাল আর নৌকায়। চষে বেড়াচ্ছে খাল-নদী থেকে সাগরের অথৈই পানিতে। এদের অনেকের লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবা-মায়ের অনীহার কারণে তা আর হয়ে ওঠে না।এসব শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজেদের ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে বাবা-মা তাদের পড়ালেখা করাতে চায় না। দু’একজন বাবা-মা  সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করালেও অবসর সময়ে কাজে পাঠিয়ে দেন। যে কারণে তারা বাড়িতে পড়ালেখার সুযোগ পায় না।জানতে চাইলে ফারুক জানায়, সে এখন আর স্কুলে যায় না। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে যাওয়া-আসা করলেও সে ক্লাসের পড়া ঠিকমতো মুখস্থ করতে পারতো না। পড়া না পারলে শিক্ষকেরা মারতো। স্কুল শেষ হলে বাবা-মা তাকে নৌকায় পাঠিয়ে দিতো। এখন সে ডিঙি নৌকায় মাছ ধরে পরিবারে অর্থের জোগান দিচ্ছে।রিয়াজ জানায়, সে স্থানীয় এ হালীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল শেষে বাবা মনির উদ্দিনের সঙ্গে মাছ ধরতে চলে যায় নদীতে।মনির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কি করুম (করবো)? আন্ডাতো (আমরাতো) গরীপ (গরীব)। আর (আমার) একার হক্কে (পক্ষে) হরিবার (পরিবার) চালানো কঠিন। তাই স্কুল শেষ অইলে হালারে লই মাছ ধইত্তে চলি যাই।’একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে রসের উদ্দিন বাপ্পী। তার রোল ৩২। পড়াশুনা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে সে বলে, সকালে স্কুলে যাই। দুপুরে ফিরে এখানে (নৌকায়) চলে আসি। বিকালে মাছ ধরি। রাতে এখানেই থাকি।নিয়মিত স্কুলে যেতে চায় মিঠু। কিন্তু অভাব-অনটনের কারণে বাবা-মা স্কুলে যেতে দেয়নি তাকে। চট্টগ্রামের একটি গরুর ফার্মে চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু মালিকের নির্যাতনের কারণে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে।গ্রামের বন্ধু ফারুক, রিয়াজ, আরীফ, সোহেলদের সঙ্গে সকালে স্কুলে যায়। রাতে থাকে পাশের বাড়ির মাঝি হারুন মিয়ার নৌকায়। বিনিময়ে সে সেখানে তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি প্রতিদিন ১০ টাকা করে পায়। স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশই খুবই দরিদ্র। যে কারণে ছেলে মেয়েদের স্কুলে যেতে দিতে চান না। নিজের সঙ্গে রেখে অল্প বয়সেই নৌকা এবং জাল ধরার কাজ শিখিয়ে তোলেন।ক্ষুদে এই জেলেরা জানায়, তাদের গ্রামের সচ্ছল পরিবারের ছেলেরা যখন স্কুলে যায়, তখন তাদেরও যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাজে ফাঁকি দিলে বাবা-মায়ের হাতে মার খেতে হয়। অনেক সময় কোনো কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে খাবারও বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যেও যাদের অধিক আগ্রহ তারাই শুধু নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে।  অথচ ঝরে পড়া এসব শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এদের জন্য প্রতিটি গ্রামে একটি করে রস বা আনন্দ স্কুল রয়েছে। কিন্তু এসব স্কুলের শিক্ষকেরা অন্য স্কুলের শিক্ষকদের মতো সব সুযোগ-সুবিধা নিলেও পাঠদান করেন না।  এমএসএস/এমএমজেড/এমএস

Advertisement