ফিচার

শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুণ্ডুবাড়ির মেলা

শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুণ্ডুবাড়ির মেলাকে বলা হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত কুণ্ডুবাড়ির মেলায় আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানই বেশি। এই তো আমাদের গ্রামবাংলার সম্প্রীতির চিরায়ত সংস্কৃতি। এমন মিলনমেলা আমাদের অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। কেননা বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।কুণ্ডুবাড়ির মেলা দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়- একদিকে মন্দিরে চলে পূজার্চনা। অন্যদিকে বিশাল এলাকাজুড়ে পণ্যের বেচাকেনা। সর্বোপরি বাধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ে বিনোদন মঞ্চে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসে তাদের পণ্যের পসার সাজাতে। দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ আসবাবপত্রের মেলা হিসেবে খ্যাত কুণ্ডুবাড়ির মেলাকে সফল করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসে স্থানীয় মুসলমানরা। গ্রামবাংলার শতবছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে দলমত নির্বিশেষে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আন্তরিকতার কমতি নেই স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের।কুণ্ডুবাড়ির মেলার উৎপত্তির ইতিহাস দুর্বোধ্য হলেও ধারণা করা হয়, স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার গোপালপুর গ্রামের কুণ্ডুবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুণ্ডুবাড়ির মেলা। সঠিক দিন-তারিখ কেউ না জানলেও ধরে নেওয়া হয় আনুমানিক আঠারো শতকের শেষের দিকে কুণ্ডুদের পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় উৎসব কালীপূজার আয়োজন করে। ক্রমান্বয়ে তাদের পূজাকে ঘিরে প্রথমে বাদাম, বুট, রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স, মণ্ডা-মিঠাই ও খেলনা নিয়ে অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী বসতেন। পরে আস্তে আস্তে প্রতি বছর ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতে শুরু করেন। পরবর্তীতে স্থানীয়রা এর নামকরণ করেন ‘কুণ্ডুবাড়ির মেলা’ নামে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থিরতার মধ্যে মেলা অনুষ্ঠিত না হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ মেলা জমজমাটভাবে হয়ে আসছে।প্রতি বছরের মতো এ বছরও ২৮ অক্টোবর সকাল থেকে ১ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় কুণ্ডুবাড়ির মেলা। পাঁচ দিনব্যাপী মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা বাঁশ, বেত, ইস্পাত-কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা ও প্রসাধনীসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে আসেন। অনেকে আসেন পণ্য সামগ্রী কিনতে। পাশাপাশি নাগরদোলা, পুতুলনাচসহ বিভিন্ন বিনোদনে আকৃষ্ট হয় দর্শনার্থীরা। বস্তুত বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মেলা হয়ে ওঠে উপভোগ্য। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চাপ কম থাকলেও বিকেলের পরে বাড়তে থাকে জনস্রোত। বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয় মেলাঙ্গন। তবুও মেলার দীর্ঘ ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার নজির নেই।মেলায় আগত দর্শনার্থীরা কেউ কেউ শিশুদের জন্য খেলনা, আসবাবপত্র কিংবা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনছেন। আবার কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এতে ব্যবসায়ীদের প্রচুর লাভ হয়। কোনো ঝুটঝামেলাও নেই। মেলা উদযাপন কমিটিও যথেষ্ট আন্তরিক। কুণ্ডুবাড়ির মেলা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ণ। তাই বংশ পরম্পরায় তারা এ ঐতিহ্যকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। মেলার অগণিত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য পূজামণ্ডপের পাশে স্থায়ীভাবে একটি পুলিশ কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাদের সহযোগিতা করেন। ফলে বিশৃঙ্খলার কোনো সুযোগ নেই। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মেলাঙ্গন ঘুরে মনে হয় ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ।’ জনসমুদ্র সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে পড়ে যায়- ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা/অগ্রাণে নবান্ন উৎসবে/আবার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়/বিশ্ববাসী চেয়ে রবে।’ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুণ্ডুবাড়ির মেলা টিকে থাকুক মানুষের ভালোবাসা আর বন্ধনে। সাম্য ও মৈত্রী হোক এর একমাত্র লক্ষ্য। একই দুর্বাঘাসের শিশিরে সিক্ত হোক সবার চরণ। এক শীতল আবেশে সম্প্রীতির সুবাতাস বইয়ে দিক সবার অন্তরে। অটুট বন্ধনে চিরজীবী হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।এসইউ/আরআইপি

Advertisement