এই মুহূর্তে যদি কোনো কিশোর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি সম্পর্কে পাঠ করতে আগ্রহী হয় তাহলে দেখতে পাবে যে, বাংলাদেশে সে সময় চর দখলের মতো ঘটনাবলি ঘটেছে এবং যাদের হাতেই অস্ত্র ছিল তারাই একজন আরেকজনকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মেতে উঠেছিল। সাধারণ নাগরিকের চোখের অন্তরালে ঘটে যাচ্ছিলো একের পর এক দুর্ধর্ষ ঘটনা, যার ফল আমাদের আজও ভোগ করতে হচ্ছে, হয়তো জাতি হিসেবে ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলি আমাদের আরো বহুকাল ধরে ভুগিয়ে যাবে, কারণ এই ৭৫ সালের ঘটনা প্রবাহই আমাদের দেশের গতিপ্রকৃতি বদলেছে, বদলে দিয়েছে রাজনীতির ধরন এবং বাংলাদেশের ভাগ্যকেও কি বদলে দেয়নি সে অর্থে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গভবনে চলছে হত্যাকারী, ক্ষমতা দখলকারী আর বাংলাদেশবিরোধীদের ভয়ঙ্কর শাসন। খাওয়া-দাওয়া চলছে, ফুর্তি-ফার্তা চলছে আর ফাঁকে ফাঁকে চলছে কী করে দেশটাকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার শলাপরামর্শ। কারা নেই সেখানে? আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা কিছু রাজনীতিবিদ, যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠও ছিলেন বটে; ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ও সেই সময় কর্মরত কিছু কর্মকর্তা, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, কিছু ব্যবসায়ী- সব মিলিয়ে পুতুল নবাব মুশতাককে সামনে রেখে পেছন থেকে আসরটাকে টিকিয়ে রাখছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজে। ১৯৭১ সালে কালুরঘাটে নিজেকে ‘প্রভিন্সিয়াল চিফ’ ঘোষণা দিয়ে যে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন সেই ‘প্রভিন্সিয়াল চিফ’ হওয়ার সুযোগ তার ঘটে গেছে, নেপথ্যে থেকে তিনি আসলে সর্বময় কর্তাই হয়ে উঠেছিলেন মুশতাক সরকারের। যদিও ফারুক-রশীদ-ডালিম গং-দের অস্ত্রের সামনে জিয়া একটু “ভেজা বেড়াল” টাইপ চেহারা নিয়েই ঘোরাফেরা করছিলেন, কিন্তু আবার তাদের ভয় দেখিয়ে বসে রাখার চেষ্টাতেও তিনি সফল ছিলেন। কারণ জিয়া জানতেন, খুন তিনি নিজে করেননি, তাদের দিয়ে করিয়েছেন। অতএব আইনের চোখে ফারুক-রশীদ-ডালিমরা যে পরিমাণ দোষী তিনি ততোটা নন, ইতিহাস নিয়ে তিনি হয়তো কখনোই চিন্তিত ছিলেন না কারণ তিনি জানতেন, বাংলাদেশের ইতিহাস তার হাতেই লেখা হচ্ছে তখন। ৮০ দিনের নবাবী-রাজত্ব চলছে তখন বঙ্গভবনে। বাংলাদেশের ইতিহাসের কালোতম সময় হিসেবে আমরা এই সময়টাকে দেখতে পাই। একদল খুনি মেজর ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্র ক্ষমতা। জিয়াউর রহমান তাদের ভয় দেখিয়ে বশে রাখার চেষ্টা করছে। আতঙ্কিত জাতি, আতঙ্কিত খুনিরাও, কারণ, যে কোনো সময় বিদ্রোহ হতে পারে, জনগণ খেপে উঠতে পারে। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি-জনতা সংঘবদ্ধ হচ্ছে বলেও আমরা এ সময়কার কাগজপত্র থেকে জানতে পারি কিংবা পরবর্তীতে যারা স্মৃতিচারণ করেছে এই সময় নিয়ে, সেখানেও দেখা যায় যে, খুনিরা ভয় পাচ্ছে, কিন্তু তাদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে না। সেনাবাহিনীর ভেতর চলছে ক্ষমতা প্রদর্শনের মহড়া, যে যত বেশি ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছেন তার পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সাধারণ সৈনিকরা। সেনাবাহিনীর ভেতর এই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালেই, যখন বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহকারী অফিসারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখানেও সেই জিয়াউর রহমানই এই দ্বন্দ্ব উসকে দেওয়ার খলনায়ক, তিনিই আগ বাড়িয়ে নিজের নামে ব্রিগেড খুলে তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে চাইছিলেন। বাধ্য হয়েই মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার-প্রধান জেনারেল (তখন জেনারেল ছিলেন না) শফিউল্লাহ ও খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের নামেও বিগ্রেড খোলার সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নির্দেশ অমান্য করায়, তার সেক্টরে সম্মুখ যুদ্ধে কৃতিত্বহীনতার কারণে জিয়াউর রহমানকে তার পদমর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ইতিহাসও আমরা জানতে পারি জিয়ারই সকর্মীদের লেখা ইতিহাস থেকে। ফলে এই ব্যক্তিই যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন তখন খালেদ মোশাররফের মতো অফিসারদের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। মজার ব্যাপার হলো, খোন্দকার মুশতাকের ৮০ দিনের নবাবী আমলে যেসব মীর জাফরেরা তাকে ঘিরে রেখেছিল তারা যেহেতু খুনি সেহেতু তাদের আত্মবলও ছিল কম, ফলে অত্যন্ত অল্প প্রয়াসেই খালেদ মোশাররফ একটি বিদ্রোহ ঘটাতে সক্ষম হন এবং নাটের গুরু জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন। বেশিরভাগ খুনি এ সময় দেশত্যাগ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ইতিহাস আমাদের সামনে কিছু মাহেন্দ্রক্ষণ নিয়ে হাজির হয়, সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তের সিদ্ধান্ত যে একটি জাতিকে হাজার বছরের জন্য বদলে দিতে পারে তার প্রমাণ হলো ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস। জিয়াউর রহমান বন্দি হয়েছেন খালেদ মোশাররফের হাতে। কর্নেল তাহের তার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কর্মী, সমর্থক ও বিপ্লবী সেনাসদস্যদের নিয়ে মঞ্চে নামলেন। আজকে যে ইতিহাস জাসদ নেতারা বলেন সেদিনে তাদের যে ভূমিকা ছিল তার সঙ্গে এই ইতিহাস সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় কোনো অর্থেই। কর্নেল তাহের তার রাজনৈতিক ও ক্ষমতাকেন্দ্র দখলের ইচ্ছা থেকেই দলবলসহ মাঠে নেমেছিলেন এবং ৩ নভেম্বর জেলের ভেতর জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড এই সামরিক-ডামাডোলের ভেতরই ঘটে যায়। ইতিহাস কোনোদিন কর্নেল তাহেরকে সে দায় থেকে মুক্তি দেবে তো নাই-ই, বরং ইতিহাস কর্নেল তাহেরকে সবচেয়ে উৎকটভাবে দোষী করবে খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার জন্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনওই মনে করি না যে, কর্নেল তাহেরের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, কিংবা তার সৃষ্ট রাজনৈতিক দল জাসদের ভূমিকাও কোনো অর্থেই গৌরবময় ছিল। বরং এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা ছাড়াই একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতির বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালে জাসদের সৃষ্টি হওয়া, রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিবিপ্লবী হয়ে ওঠা, বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারকে তছনছ করে দেওয়ার জন্য জাসদকে ভাবি ইতিহাস বার বার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। এটা এ কারণে যে, জাসদ-এর জন্ম না হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুন হতেন কিনা- তাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। কারণ খুনিরা খুন করেছে ঠিকই কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে জাসদের হাতে। কিন্তু তার চেয়েও জাসদের ভয়ঙ্কর অপরাধ হচ্ছে খালেদ মোশাররফের হাত থেকে জিয়াকে মুক্ত করে এনে এ দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে চিরদিনের জন্য বদলে দেয়াটা। যদিও কর্নেল তাহেরকে তার প্রাণ দিয়ে এই ইতিহাস-সৃষ্টির মূল্য দিতে হয়েছে। কর্নেল তাহেরের দেশপ্রেম, সমাজ বদলের চিন্তা কিংবা উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই কিন্তু তার হাত ধরেই বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ঘটেছে এবং অকৃতজ্ঞ জিয়াউর রহমান তাকেই ফাঁসিতে চড়িয়েছে। এরপরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান একজন নেতা হিসেবে যখন প্রতিষ্ঠিত হন তখন এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক-গম্যি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়। শুধু এই কারণেই অর্থাৎ যে মানুষটি জিয়াউর রহমানের প্রাণ ভিক্ষে দিয়েছিলেন সেই মানুষটিকে সজ্ঞানে হত্যা করার মতো অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি কী করে জাতীয় নেতা হন- সে প্রশ্ন তোলার কথা আমাদের অনেক সুশীল ইতিহাসবিদেরও কেন মনে হয় না, কেন তাদের বিবেকে এই প্রশ্ন তৈরি হয় না বা তারা কোথায় বিবেক বন্ধক রেখেছেন- সেটা আমাদের ইতিহাস-চর্চায় একটি বড় প্রশ্ন হয়েই থাকবে। জেলের ভেতর জাতীয় নেতাদের নির্মমভাবে হত্যার পর ৭ নভেম্বর যখন জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক কারণেই পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান সৃষ্ট রাজনৈতিক দল ও তার হাতে পুনর্বাসিত স্বাধীনতা-বিরোধীদের কাছে ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস কিন্তু জাতির কাছে তো দিনটি ভয়ঙ্কর কালো দিবস, কারণ জেলের ভেতর নিহত নেতাদের অবদান ও প্রজ্ঞার কাছে জিয়াউর রহমান নিতান্তই খর্বাকায়। আর এই খর্বাকায় ব্যক্তিটিই কিনা শেষ পর্যন্ত দেশের ইতিহাসের গতিপথই পাল্টায়নি আমাদের উপহার দিয়েছে কালো টাকার রাজনীতি, দুর্নীতির অবাধ ক্ষেত্র, হাজারে হাজারে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, রাজাকারের উত্থান এবং সর্বোপরি সেনা ছাউনিতে একটি রাজনৈতিক প্লাটফরমের জন্ম দিয়ে সেখানে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন খুনি, কালোবাজারি, দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও সাবেক সামরিক এবং বেসামরিক আমলাদের। রাজনীতির এ দুর্বৃত্তায়ন থেকে জাতি এরপর আর কোনোদিনই মুক্তি পায়নি, মনে হচ্ছে না আর কখনও মুক্তি পাবেও। শুরুতেই বলেছিলাম, ১৯৭৫ সালকে কেউ যদি নির্মোহ গবেষকের দৃষ্টিতে দেখেন তাহলে বাঙালি জাতির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সব স্পষ্ট হয়ে উঠবে চোখের সামনে। ওপরে সেই সময়কার যতোটুকু বিবরণ দেওয়া হলো, তা নিঃসন্দেহে যে কোনো থ্রিলারকে হার মানাবে। এখানে কোনো কথাই আমার নিজের কথা নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকেই সংগৃহীত এসব তথ্য প্রামাণ্য কি প্রামাণ্য নয় সে প্রশ্ন তোলার অবকাশ এ কারণেই কম যে, সে সময়ের অনেক কুশীলবই এখনও পর্যন্ত জীবিত রয়েছেন। সুতরাং, এই ইতিহাস ঝালাই করে নেওয়ারও সুযোগ এখনও পর্যন্ত আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাদেরই চোখের সামনে ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি হচ্ছে, নিজেদের মতো করে ইতিহাসের বর্ণন চলছে সর্বত্র। নাহলে স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাস যেমন বদলানোর ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল তেমনই ১৫ আগস্ট কিংবা ৩ নভেম্বরের রক্তাক্ত ইতিহাসও কি করে বিকৃতির খপ্পরে পড়ে সেটি আমার বোধে আসে না। হ্যাঁ, দুঃখ হয়, ক্ষোভের সঞ্চার হয় এটা ভেবে যে, জাতীয় নেতাদের নিরস্ত্র অবস্থায় জেলের ভেতর হত্যাকারীরা কী করে এখনও ‘বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস উদযাপনে সাহসী হয়? এ প্রশ্ন আমরা কেউ তুলি না যে, বিপ্লব আসলে কার? কিসের সংহতি? যদিও তাদের সাহসের কথা আর কী বলবো, তারা তো জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের দিনও কয়েকশ’ পাউন্ড ওজনের কেকের মধ্যে ছুরি বসায়- ইতিহাস বোধ করি একেই আবর্জনা বলে থাকে। ঢাকা ১ নভেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৬লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।এইচআর/পিআর
Advertisement