বেসরকারি টিভি চ্যানেল দীপ্ত টিভিতে প্রচার হওয়া বাংলা ডাবিং করা তুর্কি সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমান’ তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই একটি অনুষ্ঠান দিয়েই চ্যানেলটি আলোচনায় এসেছে এবং টিআরপি র্যাংমকিংয়েও ভালো একটি অবস্থান করে নিয়েছে। দীপ্ত টিভির পাশাপাশি দেশের আরো বেশ কিছু চ্যানেল এরই মধ্যে ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়াল প্রচার শুরু করেছে এবং আরো অনেক চ্যানেল সেই পরিকল্পনা করছে। তার মধ্যে সম্প্রতি প্রচার শুরু হয়েছে মাছরাঙা টেলিভিশনে টিপু সুলতান। আসছে ১ নভেম্বর থেকে একুশে টিভিতে প্রচার হবে ‘হাতিম’ এবং ১৪ নভেম্বর থেকে চ্যানেলটিতে শুরু হবে ‘সীমান্তের সুলতান’ নামের একটি সিরিয়াল। শিগগিরই জিটিভিতে প্রচার হবে আরব্য রজনীর জনপ্রিয় গল্প ‘আলিফ লায়লা’, চ্যানেল আইতেও শুরু হবে একটি সিরিয়াল। হঠাৎ করে দেশীয় চ্যানেলগুলোতে বিদেশি সিরিয়াল প্রচারের হিড়িক দেখে নড়েচড়ে বসেছেন দেশের দর্শক। তারা ভাগও হয়েছেন পক্ষে-বিপক্ষে। বিশেষ করে বিদেশি সিরিয়ালের বিপক্ষে শক্ত একটি অবস্থান নিয়েছেন দেশীয় নাটক-টেলিছবির নির্মাতারা। তাদের দাবি, বিদেশি সিরিয়ালের দাপটে দর্শকরা দেশীয় নাটক-সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে দেশীয় চ্যানেলগুলো দিন দিন বিদেশি সিরিয়ালপ্রেমী হয়ে উঠলে হুমকির মুখে পড়বে দেশীয় নির্মাতাদের নির্মাণ। বাংলাদেশের টিভি নাটক কিছুদিন পরই দর্শক খরায় ভুগবে! তাই অচিরেই তারা সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অবস্থায় উত্তরণ আশা করছেন। পাশাপাশি এশিয়াটিক, আলফা আই, পিআর প্রোডাকশনের মতো বেশ কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে দাবি করা হচ্ছে, চ্যানেলগুলো যে এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টা সময় ধরে বিদেশি সিরিয়াল প্রচার করছে সেই সময়টা কিন্তু দেশীয় নির্মাণের জন্য কমে যাচ্ছে। ফলে নাটক-টেলিফিল্ম নির্মাণ কমছে। কমছে শিল্পী ও কলাকুশলীদের কাজ। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি সিরিয়ালের যে হিড়িক পড়েছে তাতে নিজেদের ইন্ডাস্ট্রিতে বেকারত্বের সংখ্যাও বাড়বে। চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, শিল্পীসহ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থেকেই বিদেশি সিরিয়াল প্রচার থেকে চ্যানেলগুলোর সরে আসা উচিত।অন্যদিকে চ্যানেলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশি সিরিয়ালগুলো কিছুতেই দেশীয় অনুষ্ঠান ও নির্মাতাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। বিষয়টি নিয়ে তারা দাঁড় করাচ্ছেন নানা যুক্তি-তথ্য। তাদের দাবি, দেশীয় নির্মাতারা যদি ভালো নির্মাণে দর্শক মুগ্ধ করে রাখতে পারতেন তবে বিদেশি সিরিয়াল আমদানি করে চালানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না। নির্মাতাদের উদাসীনতার জন্যই চ্যানেলগুলো অল্প পুঁজি খাটিয়ে ভিনদেশি সিরিয়াল থেকে বেশি মুনাফার প্রত্যাশায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে।তবে নির্মাতারা দাবি করছেন, ভালো বাজেট, চ্যানেলের আন্তরিকতার অভাবে ভালো নির্মাণ ব্যাহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে নিজেদেরও কিছুটা দায় রয়েছে। বিদেশি সিরিয়াল নিয়ে নির্মাতাদের ভাবনায় জাগো নিউজের সঙ্গে অভিনেতা-নির্মাতা মাহফুজ আহমেদ বলেন, ‘মানুষ যখন ব্যর্থ হয়, তখন নানাদিক থেকে আক্রমণ আসতে থাকে। এই আক্রমণ প্রতিহত করা বেশ কষ্টসাধ্য। তাই আগে আমাদের নিজেদের সবল হতে হবে। নির্মাণ ও ভালো গল্পে মনোযোগী হতে হবে। অন্যকে ভয় পাবার আগে নিজেকে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। এর বেশি আমি আর বলতে চাই না।’ এদিকে নির্মাতা শিহাব শাহিন বলেন, ‘বিদেশি জিনিসের প্রতি মানুষের সবসময় একটা অন্যরকম আবেদন থাকে। এটা আগেও ছিল, আগামীতেও থাকবে। কিন্তু এগুলো মানুষকে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা যাবে না। মানুষকে জোর করে খাওয়াতে গিয়ে কিন্তু আমরা আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করেছি। এখন আবার সেটা ঘুড়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। আগে মাথায় রাখতে হবে, বিদেশি সিরিয়াল চালাতে গিয়ে আমরা যেন আমাদের নাটক-সংস্কৃতিকে ধ্বংস না করি। এক কথায় বলতে চাই, আগে দেশের নির্মাতাদের প্রাধান্য দিন, আমাদের অনেক ভালো মেকার আছেন, যারা ঠিক মতো বাজেটের অভাবে সেরা কাজটা দিতে পারেন না। সুতরাং এদিকে নজর দিলে সব ঠিক হবে বলে আশা করি।’বিদেশি সিরিয়াল প্রচারে আপত্তি জানিয়ে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক ভালো নির্মাতা-শিল্পীরা আছেন তাদের বাদ দিয়ে বিদেশি সিরিয়াল কেন চালাতে হবে? আমাদের দেশে যেসব চ্যানেলে বিদেশি সিরিয়াল প্রচার হচ্ছে আমি সেগুলোর ঘোরতর বিরোধী। আর আমার নিজের মধ্যে যদি দায়বদ্ধতা থাকে তবে আমি কেন বাইরের এসব জিনিস প্রচার করবো? দেশের নাটক-সিনেমা রক্ষা করতে গেলে আমাদের যে দায়বদ্ধতা আছে সেগুলোর বিকাশ ঘটাতে হবে। আর যেসব চ্যানেল এসব প্রচার করছে সেটা দর্শকদের ভালো লাগার একটাই কারণ তা হচ্ছে মেকিং অনেক ভালো, বাজেট বেশি। আমাদের দিয়ে এমন কাজ করানো যায় যদি পরিমাণমতো বাজেট দেয়া হয়।’আর নির্মাতা মোস্তফা কামাল রাজের মতে, ‘বিদেশি সিরিয়াল চলুক, কিন্তু সেটা অবশ্যই একটা নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। আর বিদেশি সিরিয়ালগুলো অনেক বেশি বাজেট দিয়ে কিনে আনা হয়, তারপর প্রচার করা হচ্ছে। বাজেট বেশি হলে কাজ ভালো হবে এটাই স্বাভাবিক। বিদেশি সিরিয়ালগুলোর একটি পর্বে যে বাজেট থাকে সেই বাজেট দিয়ে আমাদের ধারাবাহিক নাটকের কম হলেও দশটি পর্ব হয়ে যাবে! আমরা কেমন করে এমন কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নির্মাণের মান নিয়ে লড়াই করবো? আর শুধু তাই নয়, বিদেশি সিরিয়ালগুলো প্রচারের জন্য সরকারকে সঠিকভাবে ট্যাক্সও দেয়া হচ্ছে না। এটা তো এক ধরনের অপরাধ। চ্যানেলগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থটাই উদ্ধার করে নিচ্ছে। আমরাও দর্শকদের বিনোদন দিতে চাই। সেই ভাবনা থেকে একটি চ্যানেলে পাঁচটা সিরিয়াল ঠিকভাবে চললে একটা বিদেশি সিরিয়াল চালানোর পক্ষে আমি। কিন্তু নিজের পেটে লাথি দিয়ে অন্যের ব্যবসা কেন বাড়াবো আমি! সবার আগে দেশকে প্রাধান্য দিতে হবে।’একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তরুণ নির্মাতা মাবরুর রশিদ বান্নাহ বলেন, ‘আমি শুধু সিরিয়াল নিয়ে নয়, পুরো ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করে বলতে চাই। সেটা হচ্ছে আমাদের দেশে নানা দেশের চ্যানেল চলছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশে আমাদের চ্যানেল চলছে না। এটা নিয়ে সরকার আজ পর্যন্ত আমাদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। চ্যানেলগুলো সেখানে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করলো না। এছাড়া এখন টিভিতে যেসব বিদেশি সিরিয়াল প্রচার হচ্ছে সেগুলো চড়া দাম দিয়ে চ্যানেল মালিকরা কিনছেন। কিন্তু আমাদের নাটকের বেলায় বাজেট থাকে না! এটা তো হতে পারে না। আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে অবশ্যই বাইরের সিরিয়াল আমাদের এখানে চলতে পারে। কিন্তু সেজন্য একটু সুষ্ঠু নীতিমালা দরকার। এজন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আমরা যতই এটা নিয়ে কথা বলি কোনো লাভ হবে না। ছোট একটা উদাহরণ দেই, রাষ্ট্রীয় কোনো কিছু কিংবা ধূমপানজনিত কোনো বিজ্ঞাপন টিভিতে প্রচারের জন্য সরকারিভাবে আইন প্রণয়ন করা আছে। টিভিতে কিন্তু সেগুলো প্রচার হচ্ছে না। এভাবেই সরকারের উচিত এই বিষয়েও নজর দেয়া। আর আমি শুধু সিরিয়াল নিয়ে বলছি না। বলতে চাচ্ছি সরকার একটা আইন প্রণয়ন করে বিদেশি চ্যানেলের প্রচারের সীমা বেঁধে দিক। বিজ্ঞাপন প্রচারের আধিক্য বন্ধের নির্দেশ দিক। প্রয়োজনে বিজ্ঞাপনের রেট বাড়ানোর জন্য চ্যানেলের নীতিমালা করুক। নইলে ভবিষ্যৎ খুব ভয়াবহ।’ এ প্রসঙ্গে চ্যানেলগুলোর দেশপ্রেমকেই কাঠগড়ায় তুললেন অভিনেত্রী বাঁধন। তিনি বলেন, ‘নিজের দেশের সংস্কৃতি রেখে অন্যদেরটা দেখা বা অন্যকে দেখার জন্য উৎসাহিত করার পক্ষে আমি নই। যারা এসব প্রচার করছেন তারা তো সমাজের অনেক উঁচু স্তরের মানুষ। এত বিচক্ষণ হয়েও তারা বাইরের কালচার মানুষদের আকৃষ্ট করে কীভাবে? প্রকৃত দেশপ্রেম যাদের থাকে তারা দেশীয় জিনিসকেই আগে প্রাধান্য দেয়। আমি বিদেশি সিরিয়াল আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারের বিপক্ষে।’তবে বিদেশি সিরিয়ালের ঘোর বিরোধী নন নির্মাতা মুন্তাসির বিপন। তিনি বললেন, ‘সবকিছুর নেগেটিভ এবং পজেটিভ দুটো দিক আছে। এখন স্টার জলসার দর্শক বেশি। এখন বিদেশি সিরিয়ালের জন্য যদি দর্শকরা আমাদের চ্যানেলগুলো দেখেন, তবে এটাকে আমি খারাপের কিছু দেখি না। হোক সেটা সিরিয়াল কিংবা খেলাধুলা। আর এটা আকাশ সংস্কৃতি। এটা বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তবে আমি বলতে চাই, যেসব চ্যানেল দেশের বাইরের সিরিয়ালগুলো চালাচ্ছে কিংবা আগামীতে প্রচারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাদের উচিত সমপরিমাণ বাজেট দিয়ে আমরা যারা নির্মাতা তাদের সুযোগ দেয়া। আমরাও দেখিয়ে দিতে চাই ভালো প্রোডাকশন বানাতে পারি। কিছু নির্মাতা আগামীতে এটা নিয়ে শুনেছি মানববন্ধনের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু আমি বলতে চাই, নির্দিষ্ট কোনো চ্যানেলের সামনে মানববন্ধন না করে আমাদের উচিত প্রেসক্লাবের সামনে অথবা শহীদ মিনারে কর্মসূচি দিয়ে পুরো বিষয়টা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করা।’এনই/এলএ/পিআর
Advertisement