“...নারীবাদী? ওরে বাবা! নিশ্চয়ই জামাইর সাথে গ্যাঞ্জাম”, “...মেয়েরা তখনই নিজের নিজের স্বাতন্ত্র্য আর যোগ্যতায় বাঁচার কথা বলে স্বামীর সাথে বোঝাপড়া কম থাকে”......“বিবাহিত জীবনে অসুখি মেয়েরাই বেশি বেশি অধিকার এর কথা বলে’’...“আমি কেন চাকরি করবো, আমার স্বামী এতো ভালো রোজগার করে, একটা চাইলে পাঁচটা দেয়”... “চাকরি করার চেয়ে বাচ্চাদের মানুষ করা মেয়েদের জন্য অনেক জরুরি”...“মেয়ে হয়ে জন্মেছ, মেয়ের মতো বাঁচো, কথায় কথায় ঘাড় উঁচু করোনা, মেয়ে মানুষের এতো সাহস দেখানো ভালোনা”...জীবনে এই কথাগুলো কতবার যে শুনেছি ঠিক বলতে পারবোনা। তবে এটা বলতে পারবো যে, কোন ছেলের মুখে আজ পর্যন্ত এই কথাগুলো শুনিনি। এ কথা গুলো শুনেছি আমার মা, খালা, ফুফু, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ডিগ্রিধারী মেয়ে বন্ধু, এমনকি নারীর অধিকার আন্দোলনের বিপ্লবী নারী কর্মীর মুখে। আসলে “পেট্রিয়ারকি” বা পুরুষতন্ত্রের স্কুলিং এভাবেই হয়। শার্ট-প্যান্ট এর ভিতরে যেভাবে পুরুষতন্ত্রের চর্চা হয়, তার চেয়েও ভয়ানক ভাবে চর্চা হয় শাড়ির ভাঁজে। শার্ট-প্যান্ট এর ভেতরে থাকা “পেট্রিয়ারকি” কে চ্যালেঞ্জ করা যায়, কিন্তু শাড়ির ভাঁজের পেট্রিয়ারকি তো ধোলাই হয়ে যাওয়া মগজ। রোজগার-উৎপাদন থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত হয়ে গৃহপনা-মাতৃত্ব-যৌনতার সাফল্য(?) আর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের উপর গড়ে উঠেছে এঁদের নারীত্বের সংজ্ঞা। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এই সংজ্ঞা আত্মস্থ করতে করতে এবং সমাজের শেখানো উচিত-অনুচিতের দোলাচলে দুলতে দুলতে এঁরা একসময় পুরুষতন্ত্রের প্রেসক্রাইভড ভূমিকায় অভ্যস্থ হয়ে যায়। তারপর মানুষ হয়ে বাঁচার কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়ে যখন সমাজের মনমতো “মেয়ে মানুষ” হয়ে যায় তখন তার মগজে থাকা বিশ্বাসগুলো আর মোকাবেলা করা যায় না। পুরুষতন্ত্রের লক্ষণরেখা এঁদের চারপাশে গণ্ডি এঁকে দিয়ে যুক্তি, বুদ্ধি, মেধা সব নিয়ন্ত্রণ করে। এঁরা খালি না বুঝেই ভেসে যায়, ভেসে যায় আর ফেঁসে যায়।বরং পুরুষতন্ত্রের লক্ষণরেখা ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে “নারী” বানিয়ে তোলার হাজার বছরের লৈঙ্গিক রাজনীতির ছক তছনছ করে দিতে চাওয়া নারীদের আক্রমণ করছেন এইসব পুরুষতান্ত্রিক নারীরা। পুরুষের মুখপাত্র হিসেবে এঁরা সাম্যের লড়াই করা নারীদেরকে “তসলিমা নাসরিন, নাস্তিক, ডিভোর্স প্রমোট করা, পরিবার অস্বীকার করা, বাচ্চা ঘৃণা করা, পুরুষ ঘৃণা করা, ঝগড়াটে, এ্যারোগেন্ট, রিক্সাওয়ালাদের সাথে মারামারি করা, মেয়েলি(?)কাজ ঘৃণা করা, পুরুষ হতে চাওয়া বা পুরুষের মতো রাস্তায় প্রশ্রাব করতে চাওয়া(?) মেয়ে বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেন। এলার্জি সৃষ্টি করে নারীবাদ আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতেই মূলত পুরুষতন্ত্র এই টোপ ছাড়ে। অন্যের পকেটে জীবনধারণ করা নারীরা যেমন এই টোপ গিলে প্রচার করতে থাকেন, “নারীবাদ বলে গলা ফাটানো মেয়েদের জন্য সমাজ ছারখার হয়ে যাচ্ছে, পশ্চিমা উচ্ছৃঙ্খলতা ঢুকে আমাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাদের সুমহান(?) ঐতিহ্য”। আবার, নারীমুক্তি আন্দোলনের ভেতরে থাকা কিছু বিভ্রান্ত নারী ও এই টোপ গিলে নিয়ে নারী নিপিড়নের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেয়, লেখে, আর বাসায় ফিরে "খোদার কসম আমি নারীবাদী না" স্ট্যাটাস প্রসব করে ঘোষণা করে “নারীবাদ” পুরুষতন্ত্রের পাতা ফাঁদ। এঁরা উভয়ই মূলত পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী। এই উভয় দলের জন্যই আমার গভীর সমবেদনা। একটু নিশ্চিন্তে টিকে থাকার জন্য, পরিচিতি তৈরির জন্য একটু নিরাপদ দূরত্ব থেকেই আন্দোলন করে এঁরা ভালো-খারাপের বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুরুষতন্ত্রের পার্পাস সার্ভ করে। এঁরা উভয়েই নারীবাদ নিয়ে নাক সিঁটকায় একটা কারণে। তা হলো, নারীবাদকে পুরোপুরি বোঝা এবং স্বীকার করার মানেই হচ্ছে কাজে লেগে যাওয়া। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দর্শক হিসেবে থাকার সুযোগ নারীবাদ চর্চায় নেই। সুতরাং নারীবাদকে বুঝে তা চর্চার জন্য যে মনোবল, উদ্যম এবং ঝুঁকি নিতে হয় তা এঁদের নেই। পুরুষতন্ত্রের মুখপাত্র হয়ে কাজ করা নারীরা, দয়া করে শুনুন। জেনে নিন, নারীবাদ মানেই ডিভোর্স নয়, ফ্রী সেক্স নয়, সমকামিতা নয়, পরিবারের প্রতি দায়িত্বহীনতা নয়, সিগারেট ফুঁকা নয়, সমাজ ছারখার করার জন্য অনাসৃষ্টির বিপ্লবও নয়। আবার নারীবাদ মানে নিশঃর্ত আত্মসমর্পণও নয়। নারীবাদ মানে প্রশ্ন তোলা, অবিরাম প্রশ্ন তোলা এবং চ্যালেঞ্জ করা। মূলতঃ পুরুষতন্ত্রের তৈরি সমস্ত পক্ষপাতমূলক নিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলাই নারীবাদ। স্বামী আপাতত কিছুটা সম্মান দেয়ার ভান করে, কারণ আপনাকে ছাড়া তার টাইমের ভাত হবে না, সোসাইটি-অফিস-পার্টি হবে না, নিশ্চিন্ত যৌন সুখ হবেনা...সুতরাং আপনাকে তার চাই, আপনার জন্য নয়, তার সবকিছু পরিপাটি থাকার জন্য। বিশ্বাস না হলে, একবার সিস্টেম ব্রেক করে দেখুন তো, একদিন রান্না-সংসার-সোসাইটি-বিছানা সব বন্ধ করে দেখুন তো সব ঠিকঠাক থাকে কিনা? যে ঘর কে নিজের মনে করে শহীদ হয়ে যাচ্ছেন আপনি, একবার স্বামীকে রাগিয়ে দেখুন তো, সে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলে কিনা? মাঝরাতে সন্তানসহ ঘর থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হয় যে নারী, সে ও একদিন আপনার মতোই স্বামীর ঘর কে নিজের ঘর বলে মনে করতো। নারী, দিনের শেষে এই নির্মম সত্য আপনাকে জেনে নিতেই হবে, নারীর কোন ঘর নেই, নারীর কোন দেশ নেই।স্ত্রীর কামাই খেলে স্বামীর মহান পৌরুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে যে সব স্ত্রীরা গর্ব করেন এবং নিজেদের স্ব-মহিমায় গৃহকর্ম আর সন্তান প্রতিপালনে নিযুক্ত করেছেন, তাঁদের কাছে সবিনয়ে জানতে চাই, আপনারা কেন আপনাদের কন্যা সন্তানদের জন্য এতো সময়-পয়সা নষ্ট করছেন? বলা তো যায় না, আপনার কন্যার জন্যও হয়তো এমন কোন পুরুষ অপেক্ষা করছে, আপনার মেয়ের কামাই খেলে যার পৌরুষ ধ্বংস হয়ে যাবে! নারী, পরিবর্তন চাওয়া নারীদের কটাক্ষ না করে একবার নিজের জানালাটা খুলুন, নিজের মুখোমুখি বসুন। সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে আজ আপনি তেল সাবান আর বাজার দরের খোরপোষে জীবনটা বিকিয়ে দিচ্ছেন। মাতৃত্বের মহান ফাঁদে পড়ে বাচ্চার স্কুলের মাঠে গল্প করে সময়গুলো কাটিয়ে দিচ্ছেন। একবার ভাবুন তো, পঁচিশ/ত্রিশ বছর আগে ঠিক এভাবেই আপনার মা ও দাঁতে দাঁত চেপে সংসারের আগুন গিলে আগুন হজম করেছিলেন এই আপনাকে “মানুষ” করবেন বলে। ত্রিশ বছর আগে এভাবেই আপনার স্কুলের বারান্দায় বসে মা ও স্বপ্ন দেখতেন “এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনেরে নিবে তুমি সেই দিনেরো কাছে”... ত্রিশ বছর পরে আপনি ও আজ আপনার মেয়ের স্কুলের বারান্দায় বসে তাকে “মানুষ” করেন আর একই গান করেন। আরো ত্রিশ বছর পরে আপনার মেয়েও যখন একই ভাবে তার মেয়ের স্কুলের বারান্দায় বসে একই গান গাইবে, ভেবেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসা এতো শ্রম, ত্যাগের কি হবে? এই দিন সেই দিনের কাছে কে নিয়ে যাবে? জীবনের হাল ছেড়ে দেয়া নারীরা, আদৌ আপনারা কোনদিন ভেবেছেন নিজের স্বাতন্ত্র্য আর যোগ্যতায় বাঁচা ঠিক কাকে বলে? স্বামী-স্ত্রীর জব ডেস্ক্রিপশন নয়, বরং মানুষের সম-মর্যাদায় গড়ে উঠে যে সংসার সে সংসারের সোনার আলো দেখার ইচ্ছে হয়েছে কোনদিন? স্ত্রীকে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে না রেখে তাঁর যোগ্যতাকে প্রমাণ করার অধিকার আদায়ে যে পুরুষ সহযোদ্ধা হন, সে পুরুষ কেমন হয় দেখেছেন কখনো? জেনে রাখুন, সুখি দাম্পত্য মানে স্বামী-স্ত্রীর পরষ্পরের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ নয়, সমঝোতাহীন আপোস নয়, বরং নিজেদের পারষ্পরিক ন্যায্যতা এবং অধিকারগুলোকে সম্মান দেয়া। স্বামীর পকেটকে নিজের পকেট মনে করে যাঁরা নিশ্চিন্তে আরামে নিরাপদে সুখ সুখ খেলা করছেন তাদের বলি, পিতা, স্বামি, পুত্র কারো পকেটই আদতে আপনার নয়। দাতা-গ্রহীতার সম্মান কোনদিন এক হয় না। পুরুষ চায় বলে আপনার কষ্টার্জিত ডিগ্রি দিয়ে পুরুষের ইমেজ তৈরি করেছেন। পুরুষ চায় বলে সাতপসরা সাজিয়ে বসেছেন, আর ‘অমুক ভাবি’ ‘মিসেস তমুক’ হয়ে স্বামীর পদবীকে নিজের ভাবতে শিখেছেন। আহারে, চারপাশে সমুদ্র রেখে কি বিপুল তৃষ্ণাতেই না জীবন টা পার করছেন! জীবনের এই এত রঙ, এত স্রোত, এত প্রেম, এত সুখ, এত ফুল সব কি শুধু দুটো শরীর ঘষাঘষি করে আর মন কষাকষি করে নষ্ট করার জন্য? স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি থেকে ও “স্বাতন্ত্র্যের” যে গৌরব, সেটা বুঝলেন ই না এক জীবনে! স্বামী- স্ত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রান্না করছে, দু’জনে শিফট করে সংসারের কাজ করছে, এর চেয়ে রোমাঞ্চকর প্রেম কি আর হয়? স্ত্রী রাত জেগে কাজ করছে বলে স্বামী ভোরে উঠে বাচ্চাদের রেডি করে স্কুলে দিয়ে আসছে...স্ত্রী মিটিং ছিল, রাত হয়ে গেছে, স্বামী যাহোক একটা কিছু রেঁধে টেবিলে রেখে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছে…এই সম্মান কি শুধু স্ত্রী টাকা রোজগার করছে বলে? নাকি স্বতন্ত্র যোগ্যতার প্রতি সম্মান? একবার ভাববেন দয়া করে। আহারে…এ যে সোনার জীবন…কি তীব্র অযত্নেই না কাটিয়ে দিলেন!! আর কতদিন এভাবে সময়কে হাতছাড়া করবেন? চোখ নত করে, মাথাহীন শরীর সাজিয়ে শাড়ি, গয়না, গোলাপ, হাব্বি, হানী আর লাভিউ’র প্রতারণায় নিজেকে আর কত ভোলাবেন? নিজের অধিকারের কথাটা বলুন এবার। ভালো মেয়ের ঐতিহ্য রক্ষার দায় থেকে বের হয়ে জীবনের পথে আসুন একবার। পুরুষতন্ত্রের গড়া যে সমাজের ঐতিহ্য, পুরুষের যশ, খ্যাতি, অর্জনের যে ইতিহাস, সে তো আসলে আমাদের পূর্বনারীদের আত্মত্যাগ আর বলিদানের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের প্রতিটা অক্ষর জোয়ান অব আর্ক, খনা, সুলতানা রাজিয়া, আন্তগোনে, সীতার বলিদান আর জীবন্ত কবর দেওয়া কন্যাদের, ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা নারীদের আর্তচিৎকারে লেখা হয়েছে। সেই ইতিহাসের পুণর্লিখন আমরা কোনভাবেই চাই না। তাই আমরা মরার আগেই বাঁচতে চাই। এই বাঁচতে চাওয়ারই নাম নারীবাদ। এই নারীবাদ সাম্যের কথা বলে। যেহেতু পরিবার থেকেই বৈষম্যের শুরু, তাই সাম্য না এলে প্রথম কোপটা পরিবারের উপরই পড়বে, মনে রাখবেন। নারী-পুরুষের সাম্যের লড়াই রান্নাঘর থেকেই শুরু হয়েছে, হবে। যে কোন সচেতন নারী, কোন এক সুন্দর ভোরে এই লড়াই এ শামিল হবেন আমি নিশ্চিত। হয়তো কিছু নিয়ম নীতি ঐতিহ্য ছারখার হয়ে যাবে। পরিবর্তনের জন্য একটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। আমি বিশ্বাস করি, একদিন এই পৃথিবীতে নতুন নারী আসবে। যে নারী লক্ষ-কোটি বৈষম্যপীড়িত নারীর সম্মিলিত শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করবে লিঙ্গ বৈষম্যের অপ-রাজনীতিকে। আমরা এর সুফল না পেলেও আমাদের কন্যারা, আমাদের উত্তরনারীরা নিশ্চয়ই এই পৃথিবীতে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা নিয়েই বাঁচবে। সবশেষে, গ্রিক কবি Olga Broumas এর মতো করেই বলি-“...এই আগুন লাগা পৃথিবীতেপথ খুঁজে নিতে হবে আমাদেরইনয়তো মরতে হবে পুড়ে...” এইচআর/এমএস
Advertisement