বিশেষ প্রতিবেদন

নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নে ব্যাপক কাজ হচ্ছে

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছাড়াও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক। সম্প্রতি সমাজ ও রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। কথা বলেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও। তিন পর্বে সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথম পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

Advertisement

জাগো নিউজ : রাষ্ট্র, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তবুও নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছেই। এ সহিংসতা কেন এবং নিরূপণের উপায় কি? সুলতানা কামাল : নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। বর্তমান সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারীর উন্নয়নে মৌলিক অঙ্গীকার রয়েছে। নারীর অধিকার রক্ষায় তিনি যথেষ্ট আন্তরিক। তার আন্তরিকতার কারণেই নারীর অধিকার রক্ষায় বেশ কয়েকটি আইন তৈরি হয়েছে। নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ হচ্ছে। রাজনীতি, পেশাগত ক্ষেত্রে বড় বড় জায়গায় নারীরা স্বমহিমায় অবস্থান করছেন।প্রশ্ন হচ্ছে এত কিছুর পরও কেন নারীর ওপর সহিংসতা হচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিবার, সমাজ অথবা রাষ্ট্র চিন্তায় এখনও পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব ভয়ঙ্করভাবে রয়ে গেছে। এই চিন্তা নিয়ে এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে কাজ হয়নি। তাই ব্যক্তিবিশেষের আন্তরিকতা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে নারী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা শক্তভাবে কিছু করছি বলে দাবি করতে পারছি না।নারীর অধিকার এবং সচেতনার জন্য নানা সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু একটি পরিবার নারীকে সেই পরিবর্তিত জায়গায় দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার প্রমাণ রাখছে না। নারীকে তারা অধস্তন, সমর্পিত ভূমিকায় দেখতেই অভ্যস্ত। ফলে একজন নারী যখন বলছেন, আমি এভাবে জীবনকে দেখতে চাই না। এভাবে আমার জীবনকে নিয়ে চিন্তা করছি। আমার জীবন আমি স্বাধীনভাবে যাপন করতে চাই। আমার জীবন অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করবে না। তখন পরিবারে অন্য সদস্যরা সেটি মানতে পারছে না। নারী তখন প্রতিবাদ করতে শিখছে, তখন পুরুষতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজ নারীর প্রতি সহিংস হয়ে উঠছে। নারীকে থামানোর জন্যই এই সহিংস হয়ে ওঠা।নারী এগিয়ে আসলেই বলা হয়, নারীরা অনেক বেড়ে গেছে। এ কাজ করছে ও কাজ করছে। নারী বাইরে যাচ্ছে। অমুকের সঙ্গে কথা বলছে, সময় কাটাচ্ছে নিজের ইচ্ছা মতো ...ইত্যাদি কথা এখনও নারীকে শুনতে হয়।নারীর পোশাক, চলাফেরা, মেলামেশা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে অন্য কেউ। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নারীকে সাবধান করে দেয়া যে, তাদের মত মেনে চললে সহিংসতার শিকার হবে না। নারীও ক্রমশ নিজেকে সংকুচিত করে নিচ্ছে। নিজেরাই বলছে, সেই মতে চললে অফিসে ভালো থাকি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো থাকি। কেউ বিরক্ত করে না। এ কথা তো আমাদের বিশ্বাস করানো হচ্ছে যে, নিজের পছন্দ মতো চললেই সহিংসতার শিকার হতে হবে।জাগো নিউজ : আপনারা কাজ করছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। তবুও নারী প্রশ্নে সমাজের কেন এই অধঃপতন?সুলতানা কামাল : শত বাধা দিয়েও নারীকে যখন ঘরে আটকানো যাচ্ছে না, নারী যখন ক্ষমতা চাইছে, অধিকার নিয়ে যখন কথা বলছে, ঠিক তখনই তাকে বেশি করে সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। নারী তার মত প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেই তাকে হয় এসিড মারছে, নির্যাতন করছে, কোপাচ্ছে বা হত্যা করা হচ্ছে।সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজার মতামত ছাত্রলীগ কর্মী গ্রহণ করতে পারলো না বলেই এমন নির্যাতন হলো। নারী না বলবে! এটি কখনো হতে পারে না। নারী সব কাজে শুধুই হ্যাঁ বলে যাবে। তার না বলার কোনো অধিকার নেই। সমাজে নারীর জীবনের চেয়ে পুরুষের অহং অনেক বড়। খাদিজা না বলায় বদরুল তার বন্ধু বা পরিচিতদের কাছে ছোট হতে পারে -এই শঙ্কায় তাকে এমনভাবে কুপিয়ে যখম করলো, হত্যার চেষ্টা চালালো।জাগো নিউজ : এর শেষ কোথায়?সুলতানা কামাল : সমাজের এ চিত্র দ্রুত পাল্টাবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বেগম রোকেয়া, আমার মা সুফিয়া কামাল, লীলা নাগ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইলা মিত্র, হেনা দাস, দৌলতুন্নেছা খাতুন, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, নূর জাহান বেগমরা বহুকাল ধরে সমাজের এই চিত্র বদলানোর কথা বলে গেছেন। সেজন্য যার যার অবস্থান থেকে অনন্য অবদানও রেখেছেন।তারা বার বার বলে গেছেন, নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার দেয়া হোক। বেগম রোকেয়া বলে গেছেন, ‘ভগিনীগণ বুক ঠুকিয়ে বল, আমরাও মানুষ’। সুফিয়া কামাল বলেছেন, ‘মানবাধিকারে যদি নারীর অধিকার না দেয়া হয়, তাহলে সেই মানবাধিকার পূর্ণতা পাবে না।’ ১৯৮৯ সাল থেকে সুফিয়া কামাল এই বিষয়টি বলে এসেছেন। আর ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার নারীর অধিকার এই কথার স্বীকৃতি দিয়েছে। নারী নিজে তার অধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়েছে। অধিকার দাবি করছে, ভোগ করতে চাইছে। অধিকার লঙ্ঘন হলে প্রতিবাদী হয়েছে। তাদের মনমানসিকতা, চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান নারী আন্দোলন বা মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরাও প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে।কিন্তু সমষ্টিগতভাবে সমাজ এই চিন্তা ধারণ করতে পারেনি। দেশ যেমন বৈষম্যহীন আকাঙ্ক্ষার পথে চলেনি, তেমনি আইনগতভাবে নারীকে অধিকারহীন করে রাখা হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে নারী নিয়ন্ত্রিত হয় ধর্মাশ্রয়ী পারিবারিক আইন দ্বারা। আর প্রতিটি ধর্মেই নারীর প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। এই বিষয়গুলোতে রাষ্ট্র, সমাজ কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেনি।জাগো নিউজ : নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনার পরামর্শ কী?সুলতানা কামাল : এটি আসলে পরামর্শের বিষয় নয়, এটি বোধের বিষয়। যেমন- ব্যক্তি-মানসে, পরিবারে, সমাজে তেমনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই বোধ থাকতে হবে। আগে ভাবতে হবে কেন আমাদের নারীর সমধিকারের আইনটি প্রণয়ন করতে পারা যাচ্ছে না বা করা হচ্ছে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরপরও কেন তিনি পারছেন না?ধর্মআশ্রিত পুরুষতান্ত্রিক শক্তির কারণেই সম্ভব হচ্ছে না। ইসলাম ধর্মের পুরুষরা মনে করছেন, নারীকে সমান অধিকার দেয়া যাবে না। হিন্দু ধর্মে তো নারীর কোনো অধিকারই নেই। হিন্দুদের বিয়ে নিবন্ধনটাই বাধ্যতামূলক করতে পারা গেল না। এতে করে হিন্দু নারীরা স্বামীর কাছ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না। বিয়ে নিবন্ধন না থাকার কারণে তারা এসব ক্ষেত্রে আদালতের আশ্রয় নিয়েও স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে পারছেন না।জাগো নিউজ : কিন্তু রাজনীতিতে তো নারীর ক্ষমতায়ন ঘটছে?সুলতানা কামাল : শীর্ষ পদে দু-একজন নারীকে দেখলেই আপনি সমাজের সার্বিক চিত্র মূল্যায়ন করতে পারবেন না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা তো মূলত পুরুষ। তাদের মানসিকতা পুরুষতান্ত্রিকতায় ঘেরা। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নারীরাও সবাই যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতামুক্ত তাও তো নয়। তারা মনে করে, আমি যা করছি সেটাই ঠিক। তার মানে এত কিছুর পরেও আমরা সামগ্রিকভাবে মানসিক দিক থেকে বদলাতে পারিনি। এএসএস/আরএস/এবিএস