মতামত

তিন মাসেই ঘুরে দাঁড়ালো বাংলাদেশ

মানুষের ব্যক্তি জীবনের মতো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও উন্নয়ন বা অগ্রগতি একটা নির্দিষ্ট সময় পেরুনোর পরই আসে। কলোনিয়াল যুগের অবসান ঘটার পর যে সকল দেশ স্বাধীনতা লাভ করে তাদেরকে উন্নয়ন ও সফলতা লাভ করতে মোটামুটি ভাবে চল্লিশ বছর বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশিই লেগে গেছে। এমনকি ভারতের মতো একটি বিশাল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রায় পঞ্চাশ বছর লেগেছে ঘুরে দাঁড়াতে। কিন্তু ভারতের পাশেই যে পাকিস্তান, সে দেশটি এখনও পর্যন্ত পারেনি নিজেদের থিতু করতে, রাষ্ট্র হিসেবেই তার অবস্থান এখন টলোমলো। এ সব বিষয় বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, বাংলাদেশ আসলে ব্রিটিশ কলোনি থেকে পাকিস্তানের কলোনিতে পরিণত হয়েছিল বলে বাংলাদেশের যে কোনো অগ্রগতির ক্ষেত্রেই হিসেব কষতে গেলে ২৫ বছর সময়কালকে বিয়োগ দিতে হবে কারণ ২৫ বছর বাংলাদেশের পরাধীনতার কাল এবং সেই সঙ্গে যদি যোগ করি পঁচাত্তর পরবর্তী আরো দুই দশক তাহলে বলতেই হয় যে, বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে মোট ৪৫ বছরকে ধরতে হবে অন্ধকারের যুগ হিসেবে কারণ এই সময়কালে বাংলাদেশ এগুনোতো দূরের কথা, টিকে যে থাকতে পেরেছে সেটাই বিস্ময়ের।আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকাই কিংবা আরো স্পষ্ট করে গত এক সপ্তাহের বাংলাদেশের দিকে যদি দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাই যে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নাম এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে এতো ইতিবাচক ভাবে আর কখনও উচ্চারিত হতে দেখা যায়নি নিকট অতীতে। কিন্তু আমরা যদি ১ জুলাইয়ের হোলি আর্টিজানের ঘটনার পরের বাংলাদেশকে দেখি তাহলে একথা বুঝতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, বাংলাদেশ আসলে এক ভয়াবহ নেতিবাচক প্রচারণার সাগরে প্রায় ডুবে যেতে বসেছিল এই ঘটনার জের ধরে। প্রমাণ চাইলে আমি বলবো গুলশান-বনানী এলাকার হোটেল মালিকদের কাছে জিজ্ঞেস করতে, কেবল এই ঘটনাটিতে তাদের ব্যবসা কতোটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে একবার খোঁজ নিয়ে দেখুন। প্রায় প্রতিটি হোটেলকেই এখন চলতে হচ্ছে ভর্তুকি দিয়ে অথচ মে-জুন মাসেও তাদের আয় ছিল আশাতীত রকমের ভালো। আমাদের দেশে বহু ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত সেসব গবেষণা সরকারের নানান ছিদ্র অন্বেষণ করে থাকে বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের। কিন্তু তারা ১ জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার ওপর আঘাত সম্পর্কীয় কোনো গবেষণা করছে কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু সেটা অবশ্যই করা উচিত। বলা হয়ে থাকে যে, যে কোনো গণমাধ্যমই বিশাল ঘটনাকেও মনে রাখে মাত্র তিন দিন, বড় জোর তার চেয়ে একটু বেশি। ১ জুলাই নিয়েও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা যখন তুঙ্গে তখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিয়ে শেখ হাসিনা যে অভাবনীয় সব সাফল্যের বার্তা এদেশের মানুষকে দিয়েছেন তাতে সেসব নেতিবাচক প্রচারণা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। এবং তার পরেই যুক্ত হয়েছে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর নিয়ে বিশ্লেষণ। এসব বিশ্লেষণে দু’ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। প্রথমতঃ অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, শেখ হাসিনার শাসনামলে কেন চীনের প্রেসিডেন্টের মতো কেউ বাংলাদেশ সফরে আসছেন? যেহেতু ১৯৭১ সালে চীন পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড অবধি বলবত ছিল সেহেতু চীন আসলে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবেই বিএনপি-জামায়াতের মিত্র। এই ধরনের বিশ্লেষকরা সত্যিই একথা মনে করেন যে, বিএনপি-জামায়াত এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধী এবং সেই সঙ্গে চীনও তাদের সঙ্গে একত্রিতভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। চীন সত্যিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কিনা তার প্রমাণতো এতোক্ষণে পেয়ে যাওয়ার কথা এই বিশ্লেষকদের কিন্তু তারা যে বিএনপি-জামায়াতকেও এখনও পাকিস্তানপন্থী ও স্বাধীনতা-বিরোধী মনে করেন তার জন্য তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, কারণ এক্ষেত্রে তারা শতকরা ১০০ ভাগ সত্য। অপরদিকে দ্বিতীয় যে পক্ষটি চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর নিয়ে চিন্তা করছেন তারা বলতে চাইছেন যে, ভারতকে চটিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো হবে শেখ হাসিনা সরকারের জন্য আত্মহত্যার সামিল। এদের সঙ্গে সম্পূর্ণই দ্বিমত পোষণ করতে হচ্ছে কারণ ভারত বাংলাদেশের পরিক্ষীত বন্ধু, এতে কোনোই সন্দেহ নেই, এমনকি শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র এই দেশটি বাংলাদেশের যে কোনো বিপদে-আপদে একটি সুবিশাল ঢালের মতোই। তার সঙ্গে চীনের তুলনা টানাটা এক ধরনের বোকামিই, এ কারণে যে, চীনের সঙ্গে যে কোনো সম্পর্কই আসলে কৌশলের ও বাণিজ্যিক মিত্রতার। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটা প্রতিবেশির, আত্মীয়ের এবং সেই সঙ্গে সর্বার্থেই আন্তরিকতার, এখানে বাণিজ্যের চেয়ে সম্পর্কটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিশ্লেষকই হয়তো আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হবেন না, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যে, ভারতের মতো বিশাল ভৌগোলিক ঢাল যদি বাংলাদেশের না থাকতো তাহলে আজকে বাংলাদেশেরও পরিণতি পাকিস্তানের মতোই হতো, এ বিষয়ে আরেকদিন লেখা যাবে, আজকে আর সেদিকে না যাই। চীনের প্রেসিডেন্টের সফর-পরবর্তী বিশ্লেষণে যে কথাটি গুরুত্ব পাওয়ার মতো তাহলো একই সঙ্গে চীন ও ভারতকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার প্রমাণ শেখ হাসিনা আমাদেরকে দেখাতে পেরেছেন। কারণ চীনের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনার দেখা হয়েছে ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস ও বিমসটেক সম্মেলনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি যে টুইট বার্তা দিয়েছেন তাতে কোথাও চীনের প্রেসিডেন্টের সফর জনিত উষ্মা নেই, বরং আছে দু’টি দেশের পারষ্পারিক সহযোগিতার ইঙ্গিতই। এর সঙ্গে যদি আমরা যোগ করি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক তৈরির কূটনৈতিক সফলতাকে তাহলে একথা শেখ হাসিনার শত্রুরাও স্বীকার করবেন যে, বাংলাদেশ আসলে আর আগের অবস্থানে নেই, তা সে যেকোনো বিচারেই হোক না কেন। এমনকি এক সপ্তাহ আগের বাংলাদেশের সঙ্গেও আজকের বাংলাদেশের কোনো তুলনা টানা চলে না। আর ১ জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গেতো এই মুহূর্তের বাংলাদেশকে কোনো ভাবেই মেলানো যাবে না। কূটনৈতিক এই সাফল্যের অর্থনৈতিক মূল্য যে কতোটা সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্র বিজ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জনের প্রয়োজন নেই। ইতোমধ্যেই প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকেই যে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বাংলাদেশের এই সাফল্য সম্পর্কে। কিন্তু আগেই বলেছি, বাংলাদেশকে বিপদে পড়তে দেখলে কিংবা বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে গেলে যারা ব্যাপক খুশি হন তাদের জন্য বিগত সপ্তাহকাল ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের এবং দুশ্চিন্তারও। কারণ, তারা এটুকু বুঝেন যে, দেশের মানুষ আর এখন ‘বেকুব’ নয় কিংবা তাদেরকে ‘বেকুব বানিয়ে রাখার প্রকল্পও’ এখন আর কাজে আসছে না বা আসবে না আর কখনওই। সর্বশেষ যে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে তাহলো বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি। তার বাংলাদেশ সফরের কারণ নানাবিধ হতে পারে। স্মরণ করতে পারি ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন প্রধান পল উলফোভিচ বাংলাদেশ সফর করেন। সেই সফরকালে তিনি গোপন বৈঠক করেন মিরপুরস্থ ইওসেফ স্কুলে বাংলাদেশের শান্তির দূতের সঙ্গে, সকলের নজর এড়িয়ে। সেই বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা জানা না গেলেও তারপরেই কিন্তু ২০০৬ সাল ও ১/১১ এর সরকারকে দেখি বাংলাদেশে। ধারণা করাই যায় যে, সে সময়ই বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে শান্তিতে নোবেল দিয়ে একটি অরাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল। এরপর ঢাকা আরো ঘনবসতিপূর্ণ হয়েছে এবং বাংলাদেশ গত সাত/আট বছরে যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে বিশ্ব ব্যাংকের নিশ্চিত বোঝার কথা যে, তাদের প্রেসক্রিপশনের সরকার আর কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু পদ্মাসেতু নিয়ে যে তোঘলকি ঘটনা বিশ্ব ব্যাংক ঘটিয়েছে তাতে এই সংস্থাটির আন্তর্জাতিক ভাবেই লজ্জিত হওয়ার কথা, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্বেক কলেজে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স বিষয়ে মাস্টার্সের ছাত্রদের বিশ্ব ব্যাংক ও পদ্মাসেতু নিয়ে পড়ানো চলছে, কারণ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে কেন বিশ্ব ব্যাংক এরকম একটি ঘটনা ঘটালো। যদিও আমরা জানি যে, মিশরের নাসের সরকারের আসোয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পেও একই ঘটনা ঘটিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক এবং তারপর যখন সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে তার জবাব দিয়েছিলেন নাসের তখন তার পরিণতিও ছিল ভয়াবহ। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা একটু হলেও নাসেরের পথ ধরেছেন, যদিও বৈশ্বিক বাস্তবতা আর নাসেরের আমলের মতো নেই। কিন্তু তাই বলে বিশ্ব ব্যাংক তার আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ক্ষমতালিপ্সা থেকে বেরিয়ে এসেছে এমন প্রমাণ এখনও কেউ দিতে পারবে না। বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান এখন বাংলাদেশ সফর করছেন, পদ্মাসেতু-সাগা’র পর এই সফরকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এর আগে তার ভাইস প্রেসিডেন্টও এসেছিলেন এদেশ সফরে। ভয় হয়, নতুন কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য তলে তলে কাজ চলছে নাতো? বাংলাদেশের সাফল্য না চাওয়ার দলটি যে বিশাল এবং তারা ছড়িয়ে আছে দেশে ও বিদেশে, তারা দেশি এবং বিদেশি উভয় প্রকারই- এই সত্যতো প্রমাণিত, নয়? শুরুতেই বলেছিলাম যে, এতো নেতিবাচক প্রচারণা ও বাঁধার পরেও যে বাংলাদেশ টিকে আছে সেটা যেমন বিস্ময়ের তেমনই বাংলাদেশের অগ্রগতিও সমানভাবে সকলের কাছে বিস্ময়ের। আমি মনে করি যে, এই অক্টোবর ২০১৬ মাসের বাংলাদেশ এক নতুন বিস্ময় নিয়ে আগামিতে আমাদের সামনে দাঁড়াবে, তাই প্রত্যেকের উচিত এই মাসটি মনে রাখা, এটা কেবল এ কারণে নয় যে, চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ-প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিংবা গোয়ায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন শেখ হাসিনা কিংবা বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করছেন, এটা এ কারণে যে, ১ জুলাইয়ের নেতিবাচক প্রচারণা ও প্রভাব থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে মাত্র তিন মাসের মাথায়, অক্টোবরে এসেই এই নেতিবাচক প্রচারণা ইতিবাচক প্রচারণায় পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য এটা সত্যিই বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা। ঢাকা, ১৭ অক্টোবর, সোমবার, ২০১৬লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্টএইচআর/পিআর

Advertisement