খেলাধুলা

মাশরাফি বলেই সম্ভব

একই ম্যাচে দুটি ঘটনা। দুটিই আবার বোলিং করার সময়। ঘটনা দুটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মাশরাফি বিন মর্তুজা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচের ঘটনা ওই দুটি। প্রথমবার যা হয়েছিল, তাতে মনে হচ্ছিল মাশরাফি বুঝি আবারও পড়ে গেলেন বিশাল ইনজুরিতে। মোহাম্মদ শাহজাদকে বোল্ড করার পরের বল করতে দৌড় দিলেন। দৌড়ে এসে বল ছোড়ার আগ মুহূর্তেই পা পিছলে পড়ে গেলেন সবার প্রিয় ম্যাশ। মুহূর্তেই নীরব মিরপুর স্টেডিয়ামে উপস্থিত ২৫ হাজার দর্শক। অধিকাংশেরই মাথায় হাত! পিনপতন নীরবতা। সবার মনে ভর করেছে তখন অজানা শঙ্কা- না জানি কী হয়! না জানি আবার বড় ইনজুরির কবলে পড়ে মাঠ ত্যাগ করতে হয় সত্যিকারের যোদ্ধা মাশরাফিকে।কিন্তু না মাঠ ছাড়লেন না তিনি। উইকেটের পাশেই বসে শুশ্রূষা নিলেন। পায়ে ব্যান্ডেজ পরানো হলো এক দফা। এরপর উঠে দাঁড়ালেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট যোদ্ধা। আবার দৌড়ে এলেন বোলিং করতে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এরপরও আগুন ঝরালেন। রানআপ একটু কম হলেও, নানা শঙ্কার দোলাচলে থাকা ম্যাচটিকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়লেন টিম বাংলাদেশের অধিনায়ক। অথচ বোলিং করার সময় যেভাবে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন, তাতে সুস্থ হয়ে উঠলেও মাশরাফির উচিত ছিল কয়েকটি ওভার ড্রেসিং রুমে বসে পাটা আরেকটু বিশ্রাম দিয়ে মাঠে নামা। এটাই ভেবেছিল সবাই; কিন্তু না, মাঠ ত্যাগ করলেন না মাশরাফি। আগের ম্যাচে আফগানদের কাছে দুঃখজনক পরাজয়ের পর তৃতীয় ম্যাচ ছিল অনেকটাই বাংলাদেশের কাছে ফাইনালের মত। শুধু তাই নয়, এক কথায় বিশাল মর্যাদা রক্ষার। এমন ম্যাচে অধিনায়ক মুহূর্তের জন্যও যদি মাঠের বাইরে যান এবং কোনোভাবে ম্যাচটা হাতের মুঠো গলে বেরিয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিত মাশরাফি হয়তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না সারাজীবন। সে কারণেই হয়তো মাঠ থেকে আর বের হলেন না ক্যাপ্টেন। গোড়ালিতে ব্যথা নিয়েও তিনি লড়াই করে গেলেন। বাংলাদেশকে এনে দিলেন ঘরের মাঠে টানা ৬টি সিরিজ জয়ের গৌরব। এমনটা হয়তো মাশরাফি বলেই সম্ভব। কারণ, যিনি নিজেকে উজাড়ই করে দিয়েছেন দেশের জন্য। যিনি মনে করেন, তার গায়ের লাল-সবুজ জার্সিটা অনেক বড় মর্যাদার প্রতীক। এই প্রতীকের চুল পরিমাণ অমর্যাদা হোক, তা জীবন দিয়েও হতে দিতে চান না নড়াইল এক্সপ্রেস।  মাশরাফির ইনজুরি প্রবণতা জানতেন বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকরা। ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে ১৩ বার ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে হয়েছে। ফিরে এসেছেন প্রতিবারই। যদিও ইনজুরির কারণে প্রিয় সংস্করণ টেস্ট ক্রিকেটটা ছেড়েই দিতে হয়েছে তাকে; কিন্তু নিজের সামর্থ্য এবং সাধ্যের মধ্যে যেটা সম্ভব, তাতে বিন্দু পরিমাণ তিনি পিছপা হবেন, সে সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই। দারুণ লড়াকু, অসীম সাহস এবং ইস্পাতকঠিন মানসিক দৃঢ়তা- এসব নিয়েই একজন কমপ্লিট ক্রিকেটার মাশরাফি। দ্বিতীয় ঘটনা একই ম্যাচে, প্রায় কাছাকাছি সময়ে। হঠাৎই মাঠে ঢুকে পড়লেন একজন সমর্থক। দৌড় দিলেন মাশরাফির কাছে। তিনি নিজেও প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। নিজেও সরে যেতে চেয়েছিলেন; কিন্তু যখন দেখলেন যে না, তিনি সত্যিই একজন খাঁটি ভক্ত। মাশরাফি নিজে এগিয়ে এসে তাকে ধরলেন। মাঠে এভাবে প্রবেশ করাটা অন্যায়- এ কারণেই হয়তো মাশরাফি চেয়েছিলেন সেই ভক্তকে বুঝিয়ে মাঠের বাইরে বের করে দেবেন। এরই মধ্যে হা রে রে রে করে ছুটে এলেন নিরাপত্তাকর্মীরা। তারা তো মাঠের মধ্যেই যেন কেয়ামত ঘটিয়ে দেবেন সেই ভক্তের ওপর; কিন্তু মাশরাফি থাকতে মাঠেই সেটা কীভাবে হয়! মাশরাফি এগিয়ে এলেন। তাকে এক পাশে সরিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের আক্রোশ থেকে নিজেই চাইলেন ভক্তকে রক্ষা করতে। নিরাপত্তারক্ষীদের হাত দিয়ে ইশারা করলেন থামার জন্য। নিজেই সেই ভক্তকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন গ্যালারির দিকে। যদিও এরই মধ্যে বিসিবির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলি এসে মাশরাফিকে বুঝিয়ে সেই পাগলা ভক্তকে ছিনিয়ে নিলেন। পরে দেয়া হলো মিরপুর থানায়।কিন্তু খেলায় যতটা না মনোযোগী ছিলেন, তার চেয়েও কেন যেন মাশরাফির মনটা পড়েছিল সেই ভক্তের কাছে। ম্যাচ শেষে এ কারণে তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে আহ্বান জানালেন, সেই ভক্তের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। সে যে একজন খাঁটি ভক্ত-সমর্থক, সেটা বুঝতে পেরেছেন মাশরাফি। যদিও এভাবে একজন দর্শকের মাঠে প্রবেশ করাটা অন্যায়, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ছিদ্র বের হয়ে পড়ে এতে। তবুও মাশরাফি তার একজন ভক্তকে আগলে রাখলেন। দলের ক্রিকেটাররা ভরসা পান তার কাছে। সাহচর্য, পরামর্শ, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, নেতৃত্ব- সবই তার কাছ থেকে পেয়ে থাকেন সতীর্থরা। ভক্তরাও এবার বুঝলেন, মাশরাফি শুধু তার সতীর্থদের জন্য নিবেদিত নন, এ দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের জন্যও সমানভাবে নিবেদিত। এটা তো সম্ভবত শুধু একজন মাশরাফি বলেই।   জাগো চ্যাম্পিয়নের ১৩তম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকেআইএইচএস/এবিএস

Advertisement