অধ্যাপক ড. দেলওয়ার হোসেন। বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন ‘জাগো নিউজ’ এর সঙ্গে।আলোচনায় গুরুত্ব পায় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ নানা বিষয়। ভৌগোলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সম্পর্কের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।জাগো নিউজ : ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা কাপাচ্ছে বিশ্ব। কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এই উত্তেজনা?অধ্যাপক ড. দেলওয়ার হোসেন : দুর্ভাগ্য হলেও এটা সত্য যে, ভারত-পাকিস্তানের জন্ম ও দক্ষিণ এশিয়ার দুঃখ একই সূত্রে গাঁথা। এ দুটি রাষ্ট্র জন্ম হওয়ার যে প্রেক্ষাপট, সেটাই পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, নিরাপত্তা ও শান্তিসহ সবকিছু নির্ধারণ করছে।এর দায় ব্রিটিশদেরও রয়েছে। কারণ তারা যখন জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তিতে দুটি দেশের সীমানা নির্ধারণ করে, তখন অনেক অমীমাংসিত জায়গা থেকে যায়। জাতিসত্তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এমন অমীমাংসিত বিষয় থাকলে পরবর্তীতে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। ১৯৪৮ সালে আমরা তাই দেখেছি। কাশ্মির প্রশ্নে এ দুটি দেশ জন্মের পরপরই যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। স্নায়ুযুদ্ধের পরেই আমরা দেখলাম, এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্ম হলো, যা এখনও আছে। ১৯৪৮ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬২ সালের ভারত-চীনের যুদ্ধ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে ভারতের অংশ নেয়া। এরপর ১৯৯৯ সালে ফের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এই সমাজ, রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।এসব ঘটনাপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কখনো ভারতবিরোধী আবার কখনো পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। একই কারণে আমাদের মতো দেশের শাসকগোষ্ঠীরা বাইরের শক্তির কাছে স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে।জাগো নিউজ : এমন জটিল পরিস্থিতি তো অন্য অঞ্চলে দেখা যায় না। ড. দেলওয়ার হোসেন : স্নায়ুযুদ্ধের পর পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই এক প্রকার স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াতেই শুধু ব্যতিক্রম ছিল। এই অঞ্চলে পরিস্থিতির কোনোই পরিবর্তন ঘটল না। অস্ত্রের মহড়া, বৈরিতা, অবিশ্বাস, সন্দেহ তীব্র হয়েছে এবং এই অঞ্চলে এক প্রকার স্নায়ুযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেছে। এর উদাহরণ হচ্ছে সার্ক। সার্কের দুর্বলতা বা এর অকার্যকর ভূমিকা মূলত এ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কের কারণেই। জাগো নিউজ : সার্কের এবারের সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। এই অবস্থায় সার্কের ভবিষ্যৎ কী? ড. দেলওয়ার হোসেন : পাকিস্তান-ভারতের টানাপোড়েনের কারণে এবারের সার্ক সম্মেলন স্থগিত হলেও নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, পাকিস্তান-বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান-আফগানিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে পাকিস্তান পার্লামেন্ট যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের নামমাত্র সম্পর্ক থাকতে পারে, তবে কার্যকর কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে আফগানিস্তানের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানিতে।পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি কোনো বিরোধ না থাকলেও ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভুটানও সার্ক সম্মেলন বয়কট করেছে। একই সঙ্গে এতগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সার্কের ইতিহাসে কখনই দেখা যায়নি। এতে করে সার্ক বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে বলে আমি মনে করি। এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা হবে তা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মনোভাবের ওপর নির্ভর করবে।জাগো নিউজ : চলমান বিরোধ অব্যাহত থাকলে সার্ক ভেঙে যাওয়া বা পাকিস্তানের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয় থাকছে কিনা? ড. দেলওয়ার হোসেন : এখন পর্যন্ত আমি সার্ক ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখছি না। কারণ সার্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বদনাম কেউ নিতে চাইবে না।আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পাকিস্তান কীভাবে এই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন করে। তবে আমি মনে করি, এই রকম পরিস্থিতির মধ্যেই সার্কের মতো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক টানাপড়েন কেন্দ্র করে সার্কের বিষয়টি মূল্যায়ন করা স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি বলে মনে করি। দীর্ঘমেয়াদি ভাবনায় সার্কের মতো আন্তর্জাতিক মানের ফোরামের গুরুত্ব অনেক বেশি। পাকিস্তান-বাংলাদেশ বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এই মুহূর্তে অনেক কঠিন বলে মনে করি। কিন্ত সার্কের মতো ফোরামে যে কোনো বিষয় নিয়ে দুটি দেশ আলোচনা করতেই পারে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই সার্কের গুরুত্ব পেয়েছে। জাগো নিউজ : সাড়ে তিন দশকের সার্ক। আদৌ কি আঞ্চলিক সমস্যা নিরসনে সার্ক কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে? ড. দেলওয়ার হোসেন : জাতিসংঘ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করে কথা বললে সার্ক নিয়ে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করি। কিন্তু এই অঞ্চলের উন্নয়নে সার্কের ভূমিকা নেই তা বলা যাবে না।দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো যে পরিবেশে আছে তারা তো সেই পরিবেশরই একটি সন্তান প্রসব করবে। এখানে তো ইইউ-এর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান প্রত্যাশা করা যায় না। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে সার্কের যেটুকু ভূমিকা রাখার কথা, তা রাখছেই বটে।আমি মনে করি, নানা চ্যালেঞ্জ থাকার পরেও সার্ক একটি কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করেছে।বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি সার্ক এই অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা রক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আপনি প্রত্যাশার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। বাস্তবায়ন পরের ধাপ। প্রত্যাশা আগের ধাপ। প্রত্যাশা ঠিক করতে পারাও এক প্রকার অর্জন বলে মনে করি।এএসএস/এআরএস/পিআর
Advertisement