‘নারীবাদ পুরুষকে আক্রমণ করে বা নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী’ এগুলো খুব কমন অভিযোগ এবং অতীতে বহুবার এসব কথার উত্তর দেয়া হয়েছে। তবু আবার বলি। নারীবাদ পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং পুরুষতন্ত্রের নীল নকশায় তৈরি লৈঙ্গিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ নিশ্চিত করতে হয়। তাই যেসব পুরুষ বা নারী নিপীড়কের ভূমিকায় থাকেন, নারী নিপীড়নকে যেকোনো ধরনের যুক্তি দিয়ে জাস্টিফাই করেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভিকটিমকে ব্লেইম করেন সেসব পুরুষ ও নারী স্পষ্টতই নারীবাদ আন্দোলনের প্রতিপক্ষ। এই পৃথিবীতে অসংখ্য নারী আছেন যারা ভয়াবহ রকমের নারীবিদ্বেষী। আবার অনেক পুরুষ আছেন, যারা নারী-পুরুষের সমতার জন্য কাজ করেন। সুতরাং নারী-পুরুষ বা কমন যে লিঙ্গই হোক না কেন, তুমি যখন পুরুষতন্ত্রকে প্রমোট করো, পুরুষতন্ত্রের সুবিধা নাও, লৈঙ্গিক সুবিধা নিয়ে নিজেকে সুপিরীয়র ভাবো, তখন তোমার সঙ্গে আমার লড়াই, তোমার সঙ্গে আমার সংঘাত- নারীবাদ তো এটাই। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই। নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের কাছে নিপীড়নের, বৈষম্যের প্রতিকার চায় না। নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের প্রেসক্রিপশনে নারীর মুক্তি খোঁজে না। এখানেই জেন্ডার আন্দোলনের সাথে নারীবাদ আন্দোলনের পার্থক্য। নিপীড়নকারী পুরুষতন্ত্র নারীবাদ আন্দোলনের প্রতিপক্ষ হলেও নারীবাদ আন্দোলনের বাতাস কিন্তু নিপীড়কের জানালায়ও পৌঁছায়। তাই নিপীড়কের ভূমিকায় থাকা পুরুষটিও এখন তার কন্যার জন্য একটি সমমর্যাদার নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারেন। এখানেই নারীবাদ আন্দোলনের সফলতা।তবু কথা ওঠে, বিতর্ক হয়। নারীবাদ নিয়ে পুরুষ বিদ্বেষ, জেনারেলাইজেশন, পুরুষ নির্যাতনকে উহ্য রাখা ইত্যাদি বিতর্কের সূচনা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ ধরনের আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক নারীবাদ আন্দোলনকে যুক্তির ধারে শানিত করে, আরো গতিশীল করবে এবং দ্রুত লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যাবে।তবে ‘সুবিধাবাদি’ সমালোচকদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, যারা নারীবাদকে অহেতুক বিতর্কে টেনে আনার জন্য কূট তর্ক তৈরি করে। ‘মানবতন্ত্র’র নামে নারীবাদের আদর্শ এবং লড়াইকে তাচ্ছিল্য করে পরোক্ষভাবে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে সাফাই গান, এ ধরনের নারী-পুরুষ উভয়কেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। (১) নারীবাদীরা পুরুষকে জেনারালাইজ করে আক্রমণ করে অনেকাংশে এটা যেমন সত্যি, আবার এটাও সত্যি যে, পুরুষরাও স্পেসিফিক করে বলে না আসলে কোন নারীবাদী কোন কোন লেখায় পুরুষকে জেনারালাইজ করে আক্রমণ করেছেন। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি যত ধরনের নির্যাতন হয়, সবটাই তো পুরুষের দ্বারা অথবা পুরুষকে কেন্দ্র করে অথবা পুরুষতন্ত্রের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ঘটে। যখনই এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলা হবে, স্বাভাবিক ভাবেই তা পুরুষের বিপক্ষে যাবে। এটা পুরুষতন্ত্রের বাই ডিফল্ট। যুগ যুগ ধরে নারী-পুরুষের বৈষম্য এত বেশি বেড়েছে, নারীর প্রতি নির্যাতনের পরিধি এত বেশি ব্যাপ্ত হয়েছে যে, কোথাও না কোথাও, কোন না কোন ফর্মে, কোন না কোন পুরুষ নারী নির্যাতনের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়।যেমন- ধর্ষণ করে এক বা একাধিক নির্দিষ্ট পুরুষ। কিন্তু এই ঘটনা কভার করতে গিয়ে যারা ভিকটিমের ছবি ছাপিয়ে রগরগে কাহিনী করে, যারা পড়তে গিয়ে যৌন সুড়সুড়ি অনুভব করে, ভিকটিম ব্লেইমিং করে যারা ভিকটিমকে পুণ পুণ নিপীড়ন করে তারা কী নারীবাদের প্রতিবাদের বাইরে থাকবে? আর যেহেতু নারীবাদ একটি নির্যাতনের চক্রকে চিহ্নিত করে প্রতিরোধ করে, তখন লৈঙ্গিক রাজনীতির তলা থেকে উপরে আসতে না পারা ‘পুরুষ’রা এভাবেই নারীবাদ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান। আসলে ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি তো কলা খাই না টাইপ হয়ে যায় ব্যাপারটা। (২) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীবাদীরা নৈর্ব্যক্তিক (?) বা নিরপেক্ষ আচরণ করে না, এ কথাও সত্য। যেখানে পুরুষতন্ত্রই সুস্পষ্টভাবে প্রতিপক্ষ, সেখানে নৈর্ব্যক্তিক বা নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ কোথায়? সভ্যতার শুরু থেকে নারীরা যেভাবে লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার হয়ে ভারসাম্যহীন, অসম, বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা মোকাবেলা করছে, সেই নারীরা যখন নিজেদের অধিকার আদায়ে প্রতিপক্ষ সুস্পষ্ট করে লড়াইয়ে নামেন, তখন সেই অবস্থান থেকে নারীদের পক্ষে নৈর্ব্যক্তিক, নিরপেক্ষ, ন্যাকা ন্যাকা লেখা সম্ভব? যখন কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর একটা প্রথাগত অন্যায়ের অপরাধের বিরুদ্ধে আক্রান্ত গোষ্ঠী নিজেরাই একা বা দলবদ্ধ হয়ে রুঁখে দাঁড়ায়, কথা বলে, প্রতিকার চায়, প্রতিহত করে তখন সে কি তার বন্ধুক নিরপেক্ষ রেখে আকাশের দিকে তাক করবে? আসলে সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে পুরুষই জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে জ্ঞানের স্রষ্টা হয়ে বসেছেন, তাই বৈষম্যপীড়িত নারীবাদকে নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক ভাষায় আন্দোলনের প্রেস্ক্রিপশন দেয়া পুরুষের একটা দায়িত্ব (?) বৈকি!(৩) পুরুষরা নির্যাতন সহ্য করে মানসিকভাবে মৃত্যুবরণ করছেন, অথচ বলতে পারছেন না। নারীবাদীরা এসব নির্যাতন নিয়ে কথা বলেন না বা সোচ্চার হন না। গুরুতর অভিযোগ বটে! নির্যাতন সে প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয়(??) যে লিঙ্গের সাথেই ঘটুক না কেন নারীবাদী মাত্রই তার প্রতিবাদ করা উচিত। শুধু একটা বিষয় আগে পরিষ্কার করা উচিত, তা হলো পুরুষরা নারীদের হাতে যে মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়, তার ধরনগুলো আসলে কী? পুরুষ নির্যাতনের ফর্ম, মোটিভ এবং প্রসেস আসলে কিরকম? পুরুষের কী চরিত্রহনন করা হয়? পুরুষকে কী অনিচ্ছাকৃত যৌন সম্পর্ক স্থাপন, গর্ভধারণ বা গর্ভপাত করতে হয়? পুরুষও কী ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের শিকার হয়? পুরুষরা কি উত্ত্যক্ত হয়, নারী দ্বারা? পুরুষ কী ধর্ষণের শিকার হয়? কোন পুরুষকে কী ফতোয়া দিয়ে দোররা বা পাথর মারা হয়, চুল কেটে দেয়া হয়? পুরুষ কী এসিডে ঝলসে যায়? পুরুষকে কী প্রকাশ্য রাস্তায় কোনো নারী কোপায়? পুরুষকে কী যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হয়? পুরুষ কী সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়? কোনো পুরুষ কি স্ত্রীর হাতে মার খায়? খেলে সেই মারের মোটিভ কী প্রথাগত শক্তি চর্চা নাকি প্রতিরোধের চেষ্টা? পুরুষকে কী কোনো প্রথা বা গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, দমন করা হয়? নাকি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে হাইলাইট করে পুরুষ আর নারী নির্যাতন সমান্তরালে এনে নারীর প্রতি ঘটা নির্যাতনগুলোকে ‘হালকা’ করার সুপরিকল্পিত গেম প্ল্যান? পুরুষ নির্যাতিত হয়, এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যে তথ্য-উপাত্ত দরকার তা কোথায়? যে সিস্টেমে সমাজ, সাক্ষ্য, আইন সব পুরুষের পক্ষে সেখানে পুরুষ কেন নির্যাতিত হলে আইনের সাহায্য নেয় না? বাধাটা কোথায়? নীরবে নির্যাতন কেন সহ্য করে পুরুষ? কেবল সরলীকরণের উদ্দেশ্যে অভিযোগ না করে যদি পুরুষ নির্যাতন আসলেই সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয় তবে তার জন্য ও কাজ হওয়া দরকার। (৪) নারীকে অনগ্রসর সমাজের একজন বলে আত্মস্লাঘা বোধ করার কিছু নেই পুরুষের। কারণ, যে লিঙ্গের অধিকারী হয়েই পুরুষ এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের কাছাকাছি ক্ষমতা ভোগ করেছে, সেটি আসলে প্রকৃতির করুণায় পাওয়া অঙ্গবিশেষ। তার ক্ষমতাবলে পুরুষ অগ্রসর আর শক্তিধর হয়ে নারীকে বঞ্চিত করেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান,আকাঙ্ক্ষা আর উচ্চাভিলাষের অধিকার থেকে। পুরুষ চাওয়া মাত্র যা যা পেয়েছেন, নারীর জন্য তার কিয়দংস অবারিত হলেই পুরুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কারণ, বঞ্চিত মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে সংগঠিত হলে কী হয় তা পুরুষ জানে। তাই আমিও বলি, এই অনগ্রসর (?) নারীর ওপর অগ্রসর (?) পুরুষের নির্ভরশীলতা আর নয়। নির্ভর যদি করতেই হয়, তবে তা হোক পারস্পরিক, সমান সমান। পুরুষকে গৃহস্থালি কাজ শিখতে হবে নিজের প্রয়োজনেই। পুরুষতন্ত্রের তৈরি করা জব ডেস্ক্রিপশন ছুড়ে ফেলেছে আজকের মেয়েরা। নারী এখন উচ্চাভিলাষী হতে চায়, নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। নারী রাজনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতিতে, সমরনীতিতে ব্যস্ত হয়েছে। নারী যুদ্ধ করবে, গ্রহ আবিষ্কার করবে, বিশ্ব-ব্রহ্মন্ডের মানচিত্র বদলাবে, ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। এখন পুরুষের সৃজনশীল(?) সাহিত্য, প্রেম, শরীর, আর রান্নাঘর বোঝার সময় নারীর হাতে নেই। সুতরাং নিজের স্বার্থেই পুরুষকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে বৈকি। পরিশেষে বলি, নারী-পুরুষের সমতার জন্য পুরুষকে নারীবাদী হতে হবে তার কোনো মানে নেই। শুধু ঢালাও অভিযোগ না করে নারীবাদকে বুঝুন, জানুন। মনে রাখবেন, নারীবাদ পুরুষের দ্বারা জীবন্ত কবর দেয়া কন্যাশিশুর চিৎকার থেকে জন্ম নিয়েছে। নারীবাদ সহমরণের নামে পুরুষের চিতায় পুড়ে খাঁটি হয়েছে। নারীবাদ বিধবার রংহীন সাদা থান থেকে জীবন বের করে এনেছে। নারীবাদ ধর্ষকের উল্লাস থেকে বের হয়ে এসেছে। হাজার বছরের দমন, নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য আর লিঙ্গবৈষম্যের অচলায়তন ভেঙ্গে রাজপথে এসেছে নারীবাদ। সুতরাং বাস্তবিক অর্থেই যদি ‘পুরুষ’ নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী হয়, তবে সংবেদনশীল হোন। লিঙ্গের জোরে নয়, মগজের জোর নিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে আসুন সমতার লড়াইয়ে।এইচএন/এবিএস
Advertisement