অধ্যাপক দেশাই সাধারণত দিনের শেষ রোগি হিসেবে আমার অফিসে আসতেন। তার শারীরিক বিষয়গুলোর চেয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, ইতিহাস নিয়ে তার আলোচনার আগ্রহ থাকতো বেশি। আমিও মনে প্রাণে উপভোগ করেছি তা। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি আমার রোগি। বোস্টন থেকে এ শহরে এসেছেন এক যুগ আগে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন তিনি। অবসর জীবন যাপনের জন্য অরল্যন্ডোতে এসেছিলেন। ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। নাতি-পুতিও আছে। ছেলে থাকেন নিউ ইয়র্কে। খ্যাতিমান ব্যাংকার সে। মেয়ে আছেন শিকাগোতে। বাবার মতো অধ্যাপনা করেন তিনিও। দেশাই সাহেব ফলিত পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক। তিনি একজন দিকপাল তার বিষয়ে। কিন্তু সারা জগতের সব কিছুতেই তার অগাধ জ্ঞান। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর একজন অন্ধ ভক্ত তিনি। ১৯৭১ এ হার্ভার্ডে বাংলাদেশের পক্ষে তার সমর্থন রেখেছিলেন শক্তভাবে। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। আমাকে দেখাতে এলে বাংলাদেশ নিয়ে নিয়মিত আধাঘণ্টা আলাপ করতেন আমার সাথে। প্রতিবারই ঘুরে ফিরে বঙ্গবন্ধুর গল্প তার। পরিপাকতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি সে সময়। সময়ের সাথে সথে ডাক্তার রোগীর সূক্ষ্ম বিভেদ রেখাটি মিলিয়ে গিয়েছিল আমাদের। তিনি অফিসে এলে আমার সারা দিনের ক্লান্তি মুছে যেত। আমি গভীর আগ্রহে তার কথা শুনতাম। আমার বাবার ছায়া পেতাম তার মাঝে। তার বয়স পঁচাশি পেরিয়েছে কয়েক মাস আগে। এ বছরটা খুব খারাপ যাচ্ছিল তার। কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচারও হয়েছে। প্রতিবারই তাকে দেখতে গিয়েছি। গেলেই মহা আনন্দে অনেকগুলো কথা বলে ফেলতেন তিনি। বারবারই আক্ষেপ করে বলতেন, ‘বাংলাদেশে যাওয়া হল না।’ এবার হ্যারিকেন ম্যাথিউ এসে যখন ফ্লোরিডায় আঘাত হানল, তখনই তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আবার। জরুরি অবস্থা চারদিকে। ছেলে-মেয়ে এসে ঘুরে গেছে দুদিন আগে। সকালে হাসপাতালে যাবার পরই মিসেস দেশাই খবর পাঠালেন যে দেশাই সাহেব আমাকে খুব দেখতে চান। আজকাজের খুব চাপ। তার মাঝেও তাকে দেখতে গেলাম। তিনি আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। আমি বসলাম। উনি বললেন, ‘ডাক্তার, এ জন্মে আর তোমার দেশে যাওয়া হল না। অনেক করলে আমার জন্য। আমার সহজ সরল জীবন। এ জীবনটা কত সহজে পার করে দিলাম।’ আমার গলা ধরে আসলো। আমি তার হাতে হাত রাখলাম। তিনি হেসে বললেন, ‘আমি আনুকে বলেছি আমাকে যেন সহজ সরলভাবে যেতে দেয়া হয়। আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে।’ আমি যখন তাঁকে ছেড়ে এলাম তখন আমি জেনে গিয়েছি যে, এ অসাধারণ মানুষটি ঠিক করে ফেলেছেন তিনি আর আমাদের সাথে থাকবেন না। তিনি মৃত্যুকে খুব সহজভাবে জড়িয়ে ধরেছেন। তিনি সহজভাবে খুব কঠিন একটি কাজ করে ফেলবেন। ঘরে ফেরার পথে মিসেস দেশাই জানালেন অধ্যাপক দেশাই আর নেই। আমরা সবাই এটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তিনি তা খুব সহজ করে দিলেন সবকিছু। কিছু কিছু অসাধারণ মানুষ জীবনের জটিলতাকে সহজ করে নেন। আমি একটি সহজ সরল জীবন চাই। সহজ সরলভাবে চলেও যেতে চাই। "The fear of death follows from fear of life. A man who lives fully is prepared to die at any time." Mark Twain.লেখক : পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিএইচআর/এবিএস
Advertisement