মতামত

বাঙালির শারদোৎসব : ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তা

বছরের এই সময়টা ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে খুব হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। হতাশা এ কারণে যে, তারিখ লিখতে গিয়ে যখন মাসের ক্ষেত্রে ১০ লিখতে হয় তখনই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি যে, বছরের দশটি মাস চলে গেলো এখনও তো কিছুই করা হলো না। আর মাত্র দু’মাস, তারপরইতো বছরটা শেষ হয়ে যাবে, কিছুই কি করা হবে? তারপর সে হতাশা বিগত সময়ের সমস্ত ব্যর্থতায় গিয়ে ঠেকে। বেশ কিছুদিন এই হতাশাবোধ নিয়ে কাটাতে হয় তখন। তারপর যথারীতি সেটা কেটে যায়, এবং এক ধরনের দার্শনিক ভাব নিয়ে নিজেই নিজেকে বলতে শুরু করি যে, কী আর হবে? জীবনটাইতো এক সময় গিয়ে শেষ হবে, কিছুই কি করা হবে? কিংবা আসলে কী বা করার ছিল? কিছুই না, কিছুই আসলে করার থাকে না, আমরা ব্যক্তিগত জীবনে বছর পার করতে থাকি একের পর এক, এবং ক্রমশঃ এগিয়ে যাই সেই অমোঘ পরিণতির দিকে। কিন্তু বছরের ঠিক এ সময়টাতে একটি বড় আনন্দের ঘটনাও ঘটে, যা হয়তো এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে একটু সহায়তাও করে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, শরতের এই সময়কাল হঠাৎ করেই যেনো জীবনবোধে একটু হলেও রঙ যোগ করে। শীতপ্রধান দেশে থাকলে এসময় দিনের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে আসতে শুরু করে কারণ গ্রীষ্ম শেষ হয়ে শীত আসার আগে গাছের সবুজ পাতারা ধূসর হতে শুরু করে এবং প্রকৃতি অদ্ভুত এক রঙে সেজে ওঠে, মূলতঃ সে রঙ গেরুয়া। আর দেশে থাকলে ঠিক এ সময়টাতেই শারদীয়া দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষ, প্রকৃতি এবং সময়টা বহুবিধ ও বিচিত্র রঙে সেজে ওঠে। আমি, আবারও বলি, ব্যক্তিগত ভাবে এই রঙ-এর উপস্থিতি আমাকে মুগ্ধ করে এবং বলাই বাহুল্য যে, আকর্ষণও করে খুউব। আমার ইচ্ছে করে, আমাদের জাতীয় জীবনেও ছড়িয়ে যাক এই রঙ, রাঙিয়ে তুলুক সমষ্টির জীবনকে। কিন্তু খুউব দুঃখজনক সত্য হলো, সেটা বেশিরভাগ সময়ই হয়ে ওঠে না, কারণ আমাদের সমষ্টির জীবন বহুবিধ ও ভয়ঙ্কর সব সমস্যাক্রান্ত। পেছনে ফিরে তাকাই যদি তাহলে দেখতে পাই যে, যে গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানে বছরের এই সময়টা সত্যিই ভিন্নরকম আনন্দের মাত্রা নিয়ে আসতো। হিন্দু প্রধান এলাকা হওয়ায় (এখন আর নেই) সেখানে আশ্বিন মাস মানেই নতুনতর আনন্দ ও সম্ভাবনা। সারা বছরের অপেক্ষা এই সময়কালের জন্য। কেবল শারদোৎসবের জন্য নয়, চারদিকে পানির ওপর ভেসে থাকা আমন ধানে তখন ফুল ঝরে গিয়ে দুধ-ধান ধরতে শুরু করেছে। ফলে ধানের আশার সঙ্গে পুজোর আনন্দ নতুন মাত্রা দিতো। খুব সমর্থ্যবান হিন্দুদের বসবাস সে এলাকায় ছিল না। কিন্তু তাতে কী? আনন্দের সঙ্গে সামর্থে্যর যোগ হয়তো সামান্যই। তবে যে এলাকার কথা আমি বলছি সেখানে দুর্গোৎসবের চেয়ে কালি পুজো হতো বেশি ধুমধাম করে। হয়তো খরচের কথা ভেবেই, কারণ দুর্গো পুজায় যে পরিমাণ খরচ হয় কালি পুজোয় ঠিক ততোটা হয় না। কিন্তু তাই বলে পুজোর এই সময়টা কি কোনো ভাবেই অবহেলা করা যায়? যায় না। তিথি মনে, সকল মাঙ্গলিক পর্বেরই সুষ্ঠু আয়োজন সম্পন্ন হতো। এবং তাতে কি অন্য ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল? ভাববার চেষ্টা করি মাঝে মাঝে। এবং দেখতে পাই যে, না খুব ব্যাপক অংশগ্রহণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের পক্ষ থেকে ছিল না। তবে তরুণদের অনেককেই দেখতাম এ সময় তার হিন্দু বন্ধুদের পুজো দেখার জন্য যেতো, নাড়ু-মোয়া-প্রসাদ খেতো এবং সাদা-কালো জীবনে একটু হলেও রঙ যোগ হতো তাতে। তখন ঘোর সামরিক আমল, জাতীয়ভাবে কী ঘটছে জানার কোনো উপায় নেই, কেবলমাত্র বিটিভি ছাড়া। আর দুর্গা পূজা মানেই বিটিভিতে অমল বোসের মহীশাসুর বধ নাটক। আর কিছুতে না হোক, আমাদের সেই সময়ে বিটিভির এই মহীশাসুর বধ-এর আয়োজনটুকু সকলেই অধীর আগ্রহ নিয়ে দেখেছে বলে জানি। কিন্তু ক্রমশঃ যখন আমাদের জাতীয়তাবোধে ধর্মকে যোগ করানোর ঘটনা ঘটছিলো ততোই এদেশের সনাতন অধিবাসীদের এই প্রধান উৎসবকে খুব কৌশলে ধর্মের রূপ দেওয়া শুরু হয়েছিল এবং রাজনৈতিক ভাবে একে ব্যবহারেরও প্রমাণ আমরা দেখেছি। তাতে যে অসুবিধেটি ঘটেছে তাহলো, বছরের এই সময়টাতে অনেকের ভেতরেই ধর্মচেতনাটাও যেনো চাগাড় দিয়ে উঠতে শুরু করে এবং মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে পুজো অর্চনায় বাধার সৃষ্টি করাটাও নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের আদম শুমারী থেকেই আমরা জানি যে, এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্রমশঃ লঘুতর হচ্ছে আর সংখ্যাগুরু আরো ‘গুরুতর’ হয়ে উঠছে, সেটা সংখ্যায় হোক কিংবা ধর্মের আধিপত্যবাদে হোক। নাহলে কী করে এমন আদেশ জারি হয় যে, সংখ্যাগুরুর প্রার্থনা চলাকালে সংখ্যালঘুর প্রার্থনার জন্য কোনো প্রকার ঢোল কিংবা কাঁসর ব্যবহার করা যাবে না? বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের যেসব সদস্য বিদেশে গিয়ে আরেকটি সংখ্যাগুরু সমাজের মধ্যে সংখ্যালঘু হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন, তারা হয়তো বুঝবেন সমস্যাটা। ধরুন ইংল্যান্ড কিংবা ইউরোপের কোনো দেশে যদি মসজিদ থেকে আজান প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়, তখন কেমন লাগবে? কিংবা ধর্মপালনে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করা হয়, তখন? জানি, এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর কারো কাছে নেই, কারণ, গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাস কেবল পেছনের দিকে হাঁটার। আমরা চারদিকে অনেক উন্নয়ন দেখি, জীবনমানের উন্নয়ন যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো ঘটনা, কিন্তু ক্রয় ক্ষমতা বাড়া কিংবা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে সচ্ছলতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের মানুষের মানসিক পরিবর্তনটি বোধ করি সমভাবে ঘটেনি। ঘটলে, আজকে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কারো কাছ থেকে এরকম নির্দেশনা আসতো না, যাতে সংখ্যালঘুর ধর্ম পালনের জন্য সংখ্যাগুরুর “দয়ার” ওপর নির্ভরশীল হতে হতো না হয়তো। সত্যি কথা বলতে কি এখানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই প্রকট আকারে চোখে পড়ে। কারণ, রাষ্ট্রই তার নাগরিককে এদেশে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু-তে বিভক্ত করে রেখেছে, সাধারণ মানুষের আর দোষ কি বলুন? অনেক পণ্ডিতই হয়তো বলবেন যে, এতো গণতন্ত্রের মূল কথা, এই বিভক্তি গণতন্ত্রে সিদ্ধ। অন্ধকে আলো দেখানোর মতো হবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বিভাজনকে নিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিতে গেলে, তাই সে পথে আজকে হাঁটবো না। আজকে আবারও সেই রঙ-এর কথা বলে শেষ করতে চাই। ধরুন, আপনি নন, একজন বিদেশি যদি এ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করে তাহলে কী দেখতে পাবেন? দেখতে পাবেন যে, দেশের বহু জায়গায় বর্ণিল সাজে সাজানো প্যান্ডেলে বিশাল মাতৃমূর্তির সামনে হাজার হাজার মানুষ করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছে (অঞ্জলীর মুহূর্তের কথা বলছি), সেখানে প্রতিটি নারী-পুরুষ-শিশু তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরিধান করেছে এবং ধূপ-ধুনো-ঢাক-কাঁসর মিলে এক অপার্থিক সৌন্দর্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এখন সে বিদেশি পর্যটকের মনে হয়তো স্বাভাবিক প্রশ্নই জাগবে, কী হচ্ছে সেখানে? আমি নিশ্চিত দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য যদি তাকে সঠিক ভাবে কেউ বোঝাতে পারেন তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা বহুলাংশেই বদলে যাবে। বাংলাদেশকে নিয়ে  সারা বিশ্বে যে নতুন পরিচয়-ধারণা সৃষ্টি হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে চাপাতির আঘাতে মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা আর হোলি আর্টিজানের ভয়ঙ্কর আক্রমণের পর থেকে, দুর্গা পুজো উপলক্ষে গোটা দেশের রঙিন উৎসব এবং দেবী দুর্গার এই সার্বজনীন ‘কনসেপ্ট’ বাংলাদেশকে এই নেতিবাচক-ধারণা থেকে বের করে আনতে সবচেয়ে শক্তিশালী ও মোক্ষম দাওয়াই হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দেশের সংখ্যাগুরু ধর্মবিশ্বাসীরাই কখনও শারদীয়া দুর্গোৎসবের এই সার্বজনীন ধারণাটি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে বহুত্ববাদকে আমাদের জাতীয় জীবনে স্থান করে দিতে। এবং সে ব্যর্থতা রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত- সকল ক্ষেত্রেই ঘটেছে। আর তাই, বাঙালি জাতি হিসেবে ক্রমশঃ একটি নেতিবাচক ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চলেছে। আক্ষেপ করে হয়তো লাভ নেই, কারণ, এই পরিণতি হয়তো হওয়ার ছিলই এবং সেটাই হচ্ছে। আগেই বলেছি যে, শিশুকাল থেকে ঋতু হিসেবে শরৎ এবং এই সময়ে উদযাপিত হওয়া এই উৎসব ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে উচ্ছ্বসিত করে এবং যে কোনো হতাশা থেকে নিজেকে টেনে বের করতে টনিকের মতো কাজ করে। আমার আশে-পাশের অনেক মানুষকে আমি দেখি সত্যিই তারাও এই উৎসবের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেন এবং মিলে-মিশে যান সমান আনন্দে, এতে তাদের ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মাচরণে কোনো সমস্যা হয় না। হওয়ার কথাও নয়, কারণ, উৎসবের রঙ কখনওই ধর্মের পথে বাধা হয় না, হতে পারে না। বাঙালির জাতীয় চরিত্রের সঙ্গে শারদোৎসবের যোগ সনাতন ও লোকায়ত। এর সঙ্গে ধর্মের যোগ সামান্যই, এবং সেটুকু হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের পালন করতে সুযোগ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এর সঙ্গে যে রঙের যোগ, তা যদি আমরা আমাদের জাতীয়তাবোধে যোগ করতে পারি তাহলে আজকে যে রক্তপাতের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটছি তা থেকে হয়তো মুক্তি এলেও আসতে পারে একদিন। যদিও আশাভঙ্গের বেদনা যেনো আমাদের জাতিগত ললাটলিখন, কারণ শিশুকাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি একে একে সংখ্যালঘু বন্ধুর হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, জীবন থেকে এবং রাষ্ট্র থেকে। ভাবতেও কষ্ট হয় যে, যে এলাকার বর্ণনা এতোক্ষণ ধরে দিয়েছি, সে এলাকায় এবার কোনো পূজো হচ্ছে না, অন্ততঃ দুর্গা পূজা হচ্ছে না, কে জানে, কালী পূজা হবে কিনা। আজকে মহা অষ্টমীর এই দিনে কোনো নিরাশার কথা বলতে চাইনি, তাও বলতে হলো, এর চেয়ে কষ্টের কিছু হতে পারে না। তবুও উৎসব এসেছে, রঙ এসেছে আমার জীবনে, আমাদের জীবনে। সবাইকে শারদ-শুভেচ্ছা। ঢাকা, ৯ অক্টোবর, রবিবার ২০১৬লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্টএইচআর/এবিএস

Advertisement