মতামত

মা-সন্তানের মাঝে বিদেশি টিভি সিরিয়াল

মাত্র বিশ-পঁচিশ বছর আগেও সন্তানের বয়স দুই-তিন বছর হলেই মায়েরা সারাদিন ব্যস্ত থাকত নিজেদের অর্জিত সমস্ত জ্ঞান সন্তানকে বিতরণের জন্য। বাড়ির সকল কাজ করার পরও সন্তানের জন্য ছিল অফুরন্ত সময়। ঘরের শিশুটির জন্য মা যেন সব থেকে আপন, সকল ব্যথার প্রধান উপশম। সন্তান কখন খাবে, ঘুমাবে এইসব ছাড়া অন্যকিছু মায়েদের মাথার মধ্যে থাকত না। এখনও মেয়েদের সময়মত বিয়ে হয়। শিক্ষার হার পূর্বের থেকে বেড়েছে। আগের মতোই সংসার আলো করে সন্তান আসে।  পূর্বে সকল বাড়িতে কাজের লোক না থাকলেও এখন তিনবেলা ঠিকমতো খাবার খেতে পারে, এমন সকল বাড়িতেই কাজের লোক আছে। সেই পুরানো কাঠের চুলার পরিবর্তে এসেছে গ্যাসের চুলা। এখন মায়েদের হাঁস-মুরগি পালতে হয় না। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যেতে যেতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন-চারজনে এসে ঠেকেছে। তবুও আগের মায়েদের মতো এখনকার মায়েদের হাতে সময় নেই। ভূতপূর্ব এক আসক্তিতে পেয়ে বসেছে বর্তমান সময়ের মায়েদের, সেটি হচ্ছে স্যাটেলাইট চ্যানেলে সম্প্রচারিত বিদেশি টিভি সিরিয়াল। টেলিভিশনের কোন চ্যানেলে কোন সিরিয়াল কখন প্রচার হয় সবকিছুই আজকের মায়েদের মুখস্থ। সেই সিরিয়াল একবার দেখার পর পুনঃপ্রচারও দেখা চাই। আদরের ছোট সন্তান কি খায়, কখন ঘুমায় সেসব দেখভাল করা যেন কাজের বুয়ার দায়িত্ব।দুই.  অধিকাংশ টিভি সিরিয়ালগুলোতে মূলত দুইটি বিষয়বস্তু দেখানো হয়। প্রথমত, পারিবারিক ও সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, অনৈতিক প্রতিযোগিতা, ঝগড়া এবং প্রতিহিংসা। এটাকে কেন্দ্র করে গোটা সিরিয়াল জুড়েই থাকে কূটবুদ্ধির চর্চা। প্রতিহিংসা রূপ নেয় একে অপরকে ধ্বংস বা হত্যা করার ষড়যন্ত্রে। দ্বিতীয়ত, পরকীয়া নামক বিষবাষ্প। এক নারীর সাথে একাধিক পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক, বিবাহবহির্ভূত মেলামেশা, আবার এক পুরুষের সাথে একধিক নারীর দৈহিক সম্পর্ক ও মেলামেশাকে কেন্দ্র করে কাহিনী আবর্তিত হয় চ্যানেলগুলোর টিভি সিরিয়ালে। আমাদের দেশের টেলিভিশন দর্শকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নারী। তবে দুঃখের বিষয়, অধিকাংশের নিউজ চ্যানেল কিংবা ডিসকভারি চ্যানেলগুলোর প্রতি আকর্ষণ নেই। যত আকর্ষণ সেই টিভি সিরিয়ালগুলো নিয়ে, যেখান থেকে মানসিক অসুস্থতা ব্যতীত অন্যকিছু আশা করা যায় না। এগুলোর রেশ মাথার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষেও রয়ে যায়। এছাড়া বিদেশি সিরিয়ালের কারনে পরির্বতন হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, যার সাথে বাঙালি সংস্কৃতির আদৌ মিল নেই। যেসব মায়েরা চাকরি করে, তারা অবস্থার প্রেক্ষিতে সন্তানদের কম সময় দেয়। কিন্তু যেসব মায়েরা সারাদিন ঘরে থাকার পরেও সন্তানকে যখন কাজের বুয়ার হাতে তিন বেলা খাবার খেতে হয়, তাদের কথা আসলেই চিন্তা করা উচিত। প্রয়োজনে কাউন্সিলিং করা যেতে পারে। সন্তানের চেয়ে টিভি সিরিয়ালের গুরুত্ব যদি মায়ের কাছে বেশি পায়, তবে ভবিষ্যতে সন্তানের কাছেও মায়ের থেকে অন্য কিছু বেশি গুরুত্ব পাবে। তিন. টমাস আলভা এডিসনের ছোটবেলোর কথা সকলের মনে আছে। একদিন এডিসন স্কুল থেকে ঘরে এসে তার মাকে একটি কাগজ দিলেন এবং বললেন, আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন শুধুমাত্র তোমাকে দেবার জন্য। তাঁর মা চিঠিটা হাতে পেয়ে অশ্রুসজল নয়নে জোরে জোরে পড়তে শুরু করলেন, ‘আপনার পুত্র অত্যন্ত মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মত যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’ তাঁর মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। এডিসন তখন সমসাময়িক সেরা আবিষ্কারক। একদিন তিনি তাঁর পারিবারিক পুরনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ড্রয়্যারের কোনায় তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন এবং সেখানে লেখা ছিল, ‘আপনার সন্তান স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’ এতক্ষণে এডিসন বুঝতে পারলেন, এটাই সেদিনের সেই চিঠি, যেটা তাঁর মা তাকে উল্টো করে পড়ে শুনিয়েছিলেন। এরপর এডিসন কয়েক ঘণ্টা কাঁদলেন এবং ডায়েরীতে লিখলেন, ’টমাস আলভা এডিসন একজন স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন শিশু ছিলেন। একজন আদর্শ মায়ের দ্বারা তিনি শতাব্দীর সেরা মেধাবী হয়ে উঠলেন।’ আজকের সকল মায়েদের বলব, আপনারাই পারেন সন্তানদের শতাব্দীর সেরা মেধাবীদের একজন করে গড়ে তুলতে। শুধু আন্তরিকতার সাথে সাধ্যমতো চেষ্টা করুন।চার. পাঁচ বছরের সন্তান রাতুলকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেত তার মা শাহানা রহমান (ছদ্মনাম)। শাহানা গ্রামেই বড় হয়েছেন। তারপর বিয়ে হয়ে যায় শহরের এক ব্যবসায়ীর সাথে। স্কুলে বাচ্চাকে রেখে অভিভাবকদের জন্য রাখা নির্দিষ্ট স্থানে অন্যান্য মায়েদের সাথে শাহানাও অপেক্ষা করতেন। অপেক্ষার পুরো সময় ধরে সব মায়েদের একই গল্প। গত রাতের বিভিন্ন সিরিয়ালের খুঁটিনাটি বিষয়াদি। আগামীতে কি ঘটবে তার একটা ভবিষ্যদ্বানী। যদি কেউ কোন সিরিয়াল না দেখত কিংবা পরে দেখেছে বলে স্বীকার করত, তবে তাকে নিয়ে অন্যরা ঠাট্টা পর্যন্ত করত। শাহানাও বোকা বনে যেত প্রায়ই। যেন অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়েছেন তিনি! শাহানাকে প্রায় তিন ঘন্টা বাচ্চার জন্য বসে থাকত হত । তবে এই সব সিরিয়ালের আলোচনা তার কখনই ভালো লাগত না। টেলিভিশনে সিরিয়াল অনুষ্ঠান দেখে তা নিয়ে কেন ঘন্টার পর ঘন্টা প্রতিদিন আলোচনা করতে হবে! বাচ্চা ঠিক মত লেখাপড়া করে কিনা, খাওয়া-দাওয়া করে কিনা, সেই সব বিষয়ে কোন কথা নেই। কিছুদিন পরে বাড়ির অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করে ঠিক হল, সকালে রাতুলের ছোট চাচা কলেজে যাবার সময় রাতুলকে স্কুলে দিয়ে আসবে এবং স্কুল ছুটির সময় শাহানা যেয়ে নিয়ে আসবে।পাঁচ. এখন অনেকের কাছ থেকেই শোনা যায়, টেলিভিশনের বিভিন্ন সিরিয়ালের প্রভাব সংসারের উপর পড়ছে। বিষয়টি এখন মায়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। দাদী, নানীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত সমস্যা হয় তখন, যখন টেলিভিশন অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নিজেদের পরিবারে প্রয়োগ করা হয়। আমাদের মায়েদের উদ্দেশে বলব, আপনারা অবশ্যই টেলিভিশন দেখবেন। তবে ভালো মন্দের বিচার বিবেচনা বোধ আপনাদের করতে হবে। আসক্তির কাছে হেরে যেয়ে নিজের সন্তানকে আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবেন না। অনেক বাংলা সিনেমার প্রায় কমন একটা ডায়ালগ, ‘মদ খেতে চাও, খাও। কিন্তু মাতাল হওয়া চলবে না।’ মায়েদের উদ্দেশে বলবো, টিভি দেখেন কিন্তু আসক্তি নয়। এমন ঘটনাও ঘটছে, সিরিয়াল দেখার জন্যে মা সন্তানকে অন্য ঘরে বন্ধ করে রেখেছেন কিংবা কাজের বুয়ার সাথে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, যাতে বিরক্ত না করে। আবার অনেকে পাশে বসিয়ে সিরিয়াল দেখছেন আর ভাবছেন, পাশেই তো আছে। এতে কিন্তু সন্তান মায়ের সাহচর্য পাচ্ছে না, টিভি-র সাহচর্য পাচ্ছে। এরপর একসময় সন্তান নিজেই ব্যস্ত হয়ে যায় টিভি, ফোন, ফেসবুকে এবং বুঝে ওঠার আগেই সে আস্তে আস্তে অনেক দূরের মানুষ হয়ে যায়। ছয়. সকল মায়েদের মনে রাখা উচিত, আপনি যদি আপনার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন না করেন, সন্তানের কাছ থেকে কিছু আশা করাও আপনার জন্য বোকামি হবে। অনেকেই উপহার দিয়ে সময় দিতে না পারার ঘাটতিটুকু পূরণ করতে চান। সন্তানকে সন্তুষ্ট রাখতে আপনি তাকে প্রতিদিনই নিত্যনতুন উপহার দিচ্ছেন। অনেকে আবার দামি দোকানের দামি খাবার খাওয়ানোকে সন্তানের প্রতি স্নেহ-ভালবাসার প্রকাশ বলে মনে করেন। এতে চাহিদা শুধু বাড়তেই থাকে। শুধু পেতেই সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আপনার প্রতি তার ভালোবাসা বাড়ে না। আপনার সন্তান আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে, এমন কিছু করা থেকে অন্তত আমাদের প্রত্যেক মায়েদের বিরত থাকা উচিত। আপনি সন্তানকে অন্য সব কিছুই দিয়েছেন, কিন্তু তার জন্যে সবচেয়ে জরুরি এবং প্রয়োজনীয় ‘সময়’ দেননি। সবকিছুই বৃথা। বাড়িতে থাকা আর সময় দেয়া এক কথা নয়। এক ঘণ্টা সময়ও যদি পান, পরিপূর্ণভাবে সময়টুকু সন্তানকে দিন। সন্তান যেন বোঝে এ সময়টুকু শুধুই তার। মায়ের মমতার শক্তিই এমন, যা দিয়ে সবকিছুকে জয় করা যায়। আজ যদি আপনি সময় না দেন, আপনার যখন প্রয়োজন হবে তখন তাদের কাছ থেকে কোন সময় আপনি পাবেন না।লেখকঃ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।riazul.haque02@gmail.comএইচআর/পিআর

Advertisement