খেলাধুলা

শততম জয়োৎসব

১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐতিহাসিক একটা দিন। ৩০ বছর আগে এই দিনটিতে সৃষ্টি হয়েছিল একটি মাইলফলক। বপন করা হয়েছিল একটি বীজ। যেটা অঙ্কুরিত হয়েছে, ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। এখন ৩০ বছরেরও বেশি বয়সের পরিণত যুবক। শ্রীলংকার মোরাতুয়ায় ৩০ বছর আগের এই দিনটিতে পাকিস্তানের কিংবদন্তী ইমরান খানের সঙ্গে টস করতে নেমেছিলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। ইমরান খানের মত ক্রিকেটারের সামনে টস করতে নেমে সেদিন নিশ্চিত বুক কেঁপেছিল গাজী আশরাফের; কিন্তু তিনি নিজেও কী সেদিন ভাবতে পেরেছিলেন, যে বীজ বপন করে দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা একদিন ক্রিকেটের আকাশে মহীরুহ হয়ে দাঁড়াতে পারবে! সেদিন হয়তো ভাবতে পারেননি। আজ বাস্তবে দেখতে পাচ্ছেন। বাংলাদেশ এখন ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম শক্তিশালি একটি দেশ। এক সময়ের পরাশক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং পাকিস্তানের চেয়েও র্যাংকিংয়ে এগিয়ে তারা। বাংলাদেশে এখন কোন ক্রিকেট শক্তি আসতে গেলে তিনবার ভাবে, পরিকল্পনা যেন-তেনভাবে নেয়ার সাহস করে না। পূর্ণ শক্তি নিয়েই আসে এদেশে। ভারত, পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলগুলো যখন বধ্যভূমিতে যেতে বাধ্য হয়েছে, তখন ক্রিকেট বিশ্বে সত্যিই বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি।১৯৮৬ সালে এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু। ওই এশিয়া কাপেই শ্রীলংকার বিপক্ষে আরও একটি ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। দু’টিতেই বড় ব্যবধানে পরাজয়। যদিও দু’টিই সমান ব্যবধান, ৭ উইকেটে। এরপরের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। পরের এশিয়া কাপে আবারও আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বাদ পেলো বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালে কেনিয়া এবং জিম্বাবুয়েকে নিয়ে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট কাপের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচের ভরসাই ছিল এশিয়া কাপ। তার আগে ৬টি এশিয়া কাপে বাংলাদেশ খেলার সুযোগ পেয়েছে মোট ১৫টি ম্যাচ। এই ১৫ ম্যাচে জয়ের আশা করা ছিল যেন বোকামিই। তবে, টানা ১০-১১ বছর এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তান এবং শ্রীলংকার সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট পেয়েছে এগিয়ে যাওয়ার রসদ।১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে আইসিসি চ্যাম্পিন্স ট্রফি জয়ের পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এদেশের ক্রিকেটের পালে নতুন হাওয়া লাগান আকরাম খান, খালেদ মাসুদ পাইলট, আমিনুল ইসলাম বুলবুলরা। তুমুল গণজাগরণ। যার ঢেউ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে আছড়ে পড়লো। উজ্জীবিত বাংলাদেশ নিজেদেও ওয়ানডে ইতিহাসে পরের বছরই প্রথম জয়টা তুলে নিলো। ১৯৯৮ সালে ভারতে বাংলাদেশ এবং কেনিয়াকে নিয়ে অনুষ্ঠিত ত্রি-দেশীয় সিরিজে প্রথমবারেরমত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জয়ের স্বাদ পেলো টিম বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের ২৩তম ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে ওই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ৬ উইকেটের ব্যবধানে। মোহাম্মদ রফিকের দারুণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের ওপর ভর করে অসাধারণ জয়টি তুলে নিলো টাইগাররা।এরপর দ্বিতীয় জয় এলো বাংলাদেশের ১০ ম্যাচ পর। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর অসাধারণ পারফরম্যান্সে স্কটিশদের ২২ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে এলো আরেকটি জয়। যার ওপর ভর করে এক বছর পর টেস্ট ঘরানায়ও নাম তুলে ফেলে টাইগাররা। নর্দাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত প্রতাপে পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে দেয় খালেদ মাহমুদ সুজনরা। ওই জয়টিই বাংলাদেশকে ঠাঁই করে দিল কুলীন শ্রেনীতে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়টিই রেখেছিল সবচেয়ে নিয়ামক ভূমিকা। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর যেন বাংলাদেশ জিততেই ভুলে গিয়েছিল। পরের জয় পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪৮টি ম্যাচ এবং প্রায় ৫ বছর। ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খরা কাটানোর পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজে প্রথম জয়ের স্বাদ পেলো বাংলাদেশ। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ৮ রানের ব্যবধানে ওই জয়ের পর অবশ্য জয়ের অভ্যাস গড়ে উঠতে থাকে টিম বাংলাদেশের। ২০০৪ সালেই তিনটি ম্যাচে জয় পায় বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় কথা, ওই বছরই ভারতের মত পরাশক্তির বিপক্ষে প্রথম জয়ের স্বাদ নিলো বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, ২০০৪ সালে ওই ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে শততম ওয়ানডে। ২০০৫ সালে এলো চারটি জয়। জিম্বাবুয়েকে নিয়মিত পরাজয়ের স্বাদ দেয়ার পাশাপাশি ওই বছরই ইংল্যান্ডের কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়টি পেয়ে গেলো বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুলের অসাধারণ সেঞ্চুরির ওপর ভর করেই ইতিহাস রচনা করে টাইগাররা। ছোটদলগুলোকে নিয়মিত হারানোর পাশাপাশি বড়দলগুলোর সামনেও যে বাংলাদেশ নিয়মিত আতঙ্ক হয়ে উঠতে শুরু করে। ২০০৬ সালে সাফল্যের পালে হাওয়া লাগে আরও বেশি। এবার ১৮টি জয় এলো বাংলাদেশের। কেনিয়া আর জিম্বাবুয়ে তো ছিলই। সঙ্গে শ্রীলংকাকেও পরাজয়ের স্বাদ দিলো টাইগাররা। ২০০৭ বিশ্বকাপের বছর। এই বছরটা এলো আরও চমক নিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপে ভারত বধের পাশাপাশি বাংলাদেশ খেলে সুপার এইটে। সেখানেও দক্ষিণ আফ্রিকার মত শক্তিশালি দলকে হারিয়ে আরও বড় চমক উপহার দেয় হাবিবুল বাশার অ্যান্ড কোং। ওই বছর জয় এসেছিল মোট ৮টি।২০০৮ সালে এসে জয়ের গ্রাফটা একটু নিন্মমুখি। তবে, প্রথমবারেরমত নিউজিল্যান্ডকে পরাজয়ের স্বাদ দিতে পেরেছে টাইগাররা। জয়ের সংখ্যা মোটে ৫টি। ২০০৯ সালে এসে আবারও শ্রীলংকার বিপক্ষে জয়। সিরিজ হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও। জিম্বাবুয়ে-কেনিয়া ছাড়া বিদেশের মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ের স্বাদ ওটাই।  ২০০৯ সালে মোট ১৪টি ম্যাচে জয় পেলো বাংলাদেশ। ২০১০ সালে এসে প্রথমবারেরমত ইংল্যান্ডকে হারায় বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে নিউজিল্যান্ডের মত শক্তিশালি দেশকে। জয় এসেছে ৯ ম্যাচে। ২০১১ বিশ্বকাপের বছর। এবার বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে পরাজয়ের স্বাদ দিতে পারলেও জয়ের গ্রাফটা ছিল নিম্নমুখী। মাত্র ৬টি ম্যাচে জিততে পেরেছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে আরও কম। মাত্র ৬টি ম্যাচে জয়। যদিও ঘরের মাঠে ভারত, শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দলকেও হারিয়েছে টাইগাররা।২০১৩ সালে এসে জয়ের গ্রাফটা আরও নিম্নমুখী। মাত্র ৫টি ম্যাচে জিতেছে বাংলাদেশ। অনেকগুলো ম্যাচ জিততে জিততেও হেরে গেছে। যদিও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আরও একটি সিরিজ জয় এসেছে বাংলাদেশের। ২০০৪ সালেল পর ২০১৪ সালটা ছিল সবচেয়ে বাজে। একের পর এক পরাজয় আর তীরে এসে তরী ডোবার কারণে যেন পুরো টিম বাংলাদেশই বিপর্যস্ত। কোন জয় নেই। মুশফিকের নেতৃত্বে পুরো দলের অবস্থাই তথৈবচ। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের শেষ দিকে দায়িত্ব দেয়া হলো মাশরাফির ঘাড়ে। দায়িত্ব পেয়েই বদলে যেতে শুরু করে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়েকে হারায় ৫-০ ব্যবধানে। ২০১৪ সালে ওই ৫টি জয়ই বাংলাদেশের সম্বল।২০১৫ ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সফল একটি বছর। বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, পাকিস্তান, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথমবারেরমত ঐতিহাসিক সিরিজ জয়। ঘরের মাঠে টানা ৫টি সিরিজ উপহার দিলেন মাশরাফিরা। এ বছর সব মিলিয়ে ১৩টি জয় এলো টিম বাংলাদেশের ঘরে। ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো ২০১৬ সালেও। যদিও এ বছর ওয়ানডে খেলা হয়েছে মাত্র তিনটি। এর মধ্যে ২টিতেই জয়।আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরে রচিত হলো আরেকটি ইতিহাস। নিজেদেও ৩১৫তম ওয়ানডেতে এসে শততম জয়ের দেখা পেয়ে গেলো বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু। ১৯৯৮ সালে এসে প্রথম জয়। এরপর ২০১৬ সালে এসে শততম জয়ের দেখা পেলো বাংলাদেশ। নিয়মিতই এখন টিম বাংলাদেশ যেভাবে প্রতিপক্ষের সামনে মুর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তরতর করেই। এমনটাই প্রত্যাশা এ দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের। জাগো চ্যাম্পিয়নের ১২তম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকেপিআর

Advertisement