মতামত

প্রেমে ব্যর্থ কোন নারী পুরুষকে কুপিয়েছে?

রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকদের ক্রমাগত ট্রমার মধ্যে ফেলে তখন কি আর ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকে? আমার কপালে ভাগ্য লাত্থি দিয়ে যাবে তা আমি হতে দেবো না। এইটা আমি বলে থাকি। এইভাবে কি সবাই ভাবে? আমার এইসব লেখালেখি পড়ে এক কবি বন্ধু বলেছিল, এইসব অর্থহীন। এসব লিখে কিছু পাল্টানো যাবে না। বলে সে তার কবিতার জগতে ফিরে গিয়েছিল, এইসব জাগতিক ট্রমা তাকে ছোঁয় কি না আমার জানা নেই। কিন্তু চিৎকার করা ছাড়া আমাদের উপায় কি? পিসি বা মোবাইল ফোনে একটা কোপানোর ছবি দেখে আমার পক্ষে নববধূর লাজরাঙা মুখ নিয়ে কবিতা লেখা সম্ভব না। আমরা লেগে থাকতে শিখিনি। ধরেন তনুর ঘটনা। হলো না, কিছু হলোই না। এরপর নামের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। এইগুলো তো নতুন কোন ঘটনা না। সেই ছোটবেলা থেকেই তো বখাটেদের দৌরাত্ন্য দেখে আসছি। আমার মতো অধিকাংশ মেয়েই দেখে আসছে। গ্রামের মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে এইসব বাজে অভিজ্ঞতা থেকে বের করার চেষ্টা করে গ্রামের বাবা-মায়েরা। মেয়ের স্বপ্নের ইতি ঘটে। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নর ইতি, শিড়দাঁড়া টানটান করে করে দাঁড়াতে চাওয়ার স্বপ্নের ইতি। আর যারা হয়তো খাদিজার মা-বাবার মতো দাঁতে দাঁত চেপে শহর পর্যন্ত, বড় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠায় মেয়েদের তাদের কারো কারো অবস্থা খাদিজার মতো হয়। খুব সরল ইক্যুয়েশন হয়ে গেল তো? মেয়েদের এতো উন্নতি, কর্মক্ষেত্র আর জিডিপিতে তাদের অবদান-এইসব আমি বললাম না তো? বড় একপেশে প্রোটোটাইপ ভাবনা এইসব, তাই না? একটা মানসিক বিকারগ্রস্থ অপরাধীর জন্য নারীর সব এগিয়ে যাওয়া তো মূল্যহীন হতে পারেনা। শোনেন, নারীর এগিয়ে যাওয়া আসলেই নারীর একার। সমাজে, সংসারে, কর্মক্ষেত্রে এরকম কম পুরুষই আছেন যারা নারীর পথচলাকে মসৃণ করতে চায়। নারীর প্রতি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ধরনধারণগুলো খুব সূক্ষ্ম আর আলাদা আলাদা। একেক নারীর একেক অভিজ্ঞতা একেকরকম। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে তাদের জুড়ি মিলবে না।  হত্যা, আত্মহত্যা প্রতিনিয়ত ঘটছে। যেগুলো সামনে আসছে সেগুলোর ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। ফরেনসিক থেকে বলেছিল, তনুর সাথে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নাই। প্রতিষ্ঠানিকভাবে হত্যা আর জুলুমকে মদদ দিয়েছে তো গণতান্ত্রিক সরকারই। আফসানার ঘটনায় একটা ব্যাপার মনে পড়ল। ঘটনা নিয়ে যখন মাতামাতি চলছে, আফসানার এক আত্নীয়, তিনি একটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক, তিনি সব সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার আপডেট দিয়ে প্রেসরিলিজ দিতেন। তো প্রেসরিলিজে উল্লেখ থাকতো, মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান আফসানার পরিবার বিচার চায়। আফসানার খুনি রবিন যদি ছাত্রলীগ নেতা হয়, তবে আফসানাও আওয়ামী রাজনীতি করা পরিবারেরই মেয়ে। অর্থাৎ, মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান না হলে বিচার চাওয়ারও সাহস নাই এখন? বলা হচ্ছে, বদরুল ছাত্রলীগ করে কি করে না সেটা মুখ্য নয়। কি অদ্ভুত কথা। অনেকে বলছেন, এরমধ্যে নারীবাদ পুরুষবাদ এনে ত্যানা প্যাঁচানোর কিছু নাই। বেশ। আনলাম না। এটা মানসিক সমস্যা। একটা বিকৃত প্রেমে অন্ধ সিরিয়াল কিলার টাইপ প্রায় উন্মাদ বদরুল কুপিয়েছে খাদিজাকে। এখন দুটা প্রশ্নের উত্তর দেন তো, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কোন নারী কবে কোন পুরুষকে এরকম কুপিয়েছে? উন্মাদ এবং বিকৃতও কেবল পুরষই হয়? না কি এটা পুরুষতন্ত্রের শক্তিশালী বাহুর বল? আচ্ছা বদরুল অসুস্থ। কেন অসুস্থ? কদিন আগে বগুড়ার একটা ঘটনা দেখেছিলাম। তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট সেখানকার একটা পার্কে গিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা জুটিগুলাকে জরিমানা করছে। একজন "ব্যাটা" সাংবাদিক সেই দৃশ্য ধারণ করছিলেন। কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে। আমাদের এখানকার পার্কগুলোতে লেখা থাকে "জুটি বেঁধে বসা নিষেধ" "পার্কের পবিত্রতা রক্ষা করুন"। এইদেশে নারী পুরুষের স্বাভাবিক সুস্থ সম্পর্ক হলো অপবিত্র এবং অসুস্থ। তাহলে সেই অসুস্থতা বদরুলদের মাথায় বাসা বাঁধবে সেটাই স্বাভাবিক। সম্পর্ককে ক্লিনিকালি নার্সিং করার কোন শিক্ষাও আমাদের পরিবার, সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো দ্যায় না। এই দায়টা কার? তাহলে আমাদের নিয়তি কি এই যে, আমরা নৃশংসতায় অভ্যস্থ হতে থাকবো। খাদিজার কোপানোর ছবি আপ করবো বা কোপানোর পর তার খুলির ছবি। তারপর অপেক্ষা করবো নতুন কোন ঘটনার জন্য।লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ডিবিসি নিউজএইচআর/আরআইপি

Advertisement