বিনোদন

গুরু জেমস আমার অক্সিজেন : জেমস পাগল প্রিন্স

‘শুভ জন্মদিন গুরু। বেঁচে থাকুন অন্তত এক কোটি বছর। অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আপনার জন্য।’ গুরুর প্রতি শিষ্যের এমন আকুতি খুব কি বেশি কিছু! মোটেও না। কিন্তু এমন কথাবন্ধনী দিয়ে যখন নগরের সুবিশাল বিলবোর্ডগুলো রাঙিয়ে দেন একজন সাধারণ ভক্ত, তখন তা বেশিকিছুরও বেশি! হয়ে ওঠেন অসাধারণ কেউ। আর এমন কাণ্ড করেই ২০১৫ সালে দেশব্যাপী খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রকস্টার এবং গুরু খ্যাত তারকা শিল্পী মাহফুজ আনাম জেমসের এক পাগল ভক্ত। নাম তার প্রিন্স মোহাম্মদ।গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের ঘটনা। হঠাৎ করেই ঢাকা শহরের মানুষ দেখতে পেল আকাশ ঢেকে দেয়া বিলবোর্ডগুলো তাদের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ভিন্ন রূপ আর রুচি ধারণ করে আছে। যে বিলবোর্ডগুলোতে সাধারণত চোখে পড়তো কোনো পণ্য সংস্থার চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন, সেখানেই প্রথমবারের মতো মানুষ দেখলো ভিন্ন ব্যাপার। চোখের সামনে দানবীয় বিলবোর্ড ঠিকই অাছে কিন্তু পণ্য কিনতে কোনো সুন্দরী নারীর প্রলুব্ধ করা আহ্বান সেখানে নেই, উদোম শরীরে ফেনা ওঠা শাওয়ারে কোনো সাবানের বিজ্ঞাপনে নায়িকার ইরোটিক চাহনিও নেই। সেসব জায়গায় স্থান করে আছেন লম্বা চুলের কালো পাঞ্জাবি আর জিন্স পরা বাংলার অতি পরিচিত এক রকস্টার। নগর বাউল তিনি। কারো কাছে তিনি গুরু জেমস। বিলবোর্ডে সুবিশাল ছবি তার। ছবির পাশে লেখা- ‘২ অক্টোবর। শুভ জন্মদিন গুরু। বেঁচে থাকুন অন্তত এক কোটি বছর। অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আপনার জন্য। গুরু জেমস।’প্রভাবশালী বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো যেখানে ঢাকা শহরে সারা বছর বিলবোর্ডগুলো দখল করে রাখে, সেখানে কোনো এক ভক্ত রকস্টার জেমসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ঢাকার প্রাইম পয়েন্টগুলোতে বিলবোর্ড লাগিয়েছেন, এমন খবর চাওর হতে একটুও দেরি হয়নি। ইলেকট্রিক, প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়া সেই খবরকে রাতারাতি জাতীয় খবরে পরিণত করে। একদিনের ব্যবধানে অপরিচিত প্রিন্স মোহাম্মদ সুপারস্টার জেমসের অনুগত ভক্ত হওয়ার বদৌলতে সারা দেশে পরিচিতি পেয়ে যান। খেতাব জোটে ‘জেমসের পাগলা ভক্ত’ হিসেবেও। যদিও জেমসের পাগলা ভক্ত হিসেবে আরো আগে, বহু আগে থেকেই নিজের জন্ম শহর কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে গোড়াপত্তন ঘটে তার।নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়। বাংলার শিল্পসাহিত্য আর সিনেমার মত বেশ রমরমা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিও। বাংলার তারুণ্য আইয়ুব বাচ্চু, জেমসের মতো রকস্টারদের গানে ঘোরগ্রস্ত। যদিও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো শিল্প-সংস্কৃতির দুয়ার। তবুও এমন উত্তাল সময় আর টালমাটাল পরিবেশের মধ্য দিয়ে সংগীত দুনিয়ায় প্রকাশ পায় জেমসের অনন্য সাধারণ কীর্তি ‘আমি জেল থেকে বলছি’। আধুনিক জীবন-যন্ত্রণাগ্রস্ত তারুণ্যের ভাষাকে কতো বলিষ্ঠ আর নির্মলভাবে উপস্থাপন করা যায় তা গানের ভাষায় নিজের সুর আর সংগীতের মাধ্যমে তুলে ধরেন জেমস। প্রখ্যাত গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলীর অনবদ্য কথায় ‘আমি জেল থেকে বলছি’র জন্য রাতারাতি তারুণ্যের একেবারে আত্মায় পরিণত হন জেমস, যা বাংলার হাজারো তরুণের মতো ছুঁয়ে যায় কিশোরগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল হোসেনপুরের প্রিন্স মোহাম্মদকে। সবে মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়েন তিনি। এই সময়েই চাচার ভাঙা টেপরেকর্ডারে শুনতেন এক পুরুষালি ভরাট কণ্ঠের শিল্পীর গান। যে শিল্পী একের পর এক গাইতে থাকেন ‘দুষ্ট ছেলের দল’, ‘ঠিক আছে বন্ধু’, ‘দুখিনী দুঃখ করো না’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘নগর বাউল’, ‘লিখতে পারিনা কোনো গান আজ তুমি ছাড়া’, ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে বন্ধু’, ‘তারায় তারায়’, ‘বিবাগী’র মতো জনপ্রিয় সব গান। এইসব গান শুনতে শুনতে ঘোরগ্রস্ত হয়ে যান প্রিন্স। মন থেকে ভালোবেসে ফেলেন গানের শিল্পীকে। স্কুলের গন্ডি থেকে এতোটাই জেমসের গানের আমুগ্ধ শ্রোতা বনে যান যে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সেই সুদূর জেলা শহর কিশোরগঞ্জ থেকে নিয়ে আসতেন জেমসের অডিও অ্যালবাম! অবশ্য এরজন্যে মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে। যে বাবা কখনও ছেলেকে একটি ধমকও দেননি তিনিই ছেলের উচ্ছন্নে যাওয়ার আশঙ্কায় বেশ করে শাসিয়ে দেন। কিন্তু ততদিনে জেমসের গানের মোহাবিষ্ট শ্রোতা বনে গেছেন প্রিন্স। শুধু যে সাধারণ শ্রোতা তা কিন্তু নয়, বরং অডিও ক্যাসেটের মোড়কে জেমসের ছবি দেখে দেখে তার স্টাইল আগাগোড়া অনুসরণ করতে থাকলেন। লম্বা চুল, পাঞ্জাবী আর জিন্সে গ্রামের সাধারণ ছেলে প্রিন্সও জেমস বেশ ধারন করার চেষ্টা করলেন। এতে কাজও হলো। পুরো হোসেনপুর অঞ্চলে জেমসের পাগলা ভক্ত হিসেবে পরিচিতি ছড়িয়ে গেল। এলাকায় সবাই তাকে ‘প্রিন্স জেমস’ বলে চিনতে লাগলো। দিনকে দিন জেমস বিষয়ক পাগলামি বাড়তেই থাকলো প্রিন্সের। এদিকে পরিবার ছেলের এহেন কর্মকাণ্ডকে বখাটেপনা হিসেবেই দেখতে শুরু করলো। এলাকার মুরুব্বিতো বটেই প্রায় প্রতিদিন স্কুল থেকেও প্রিন্সের নামে নালিশ আসতে থাকে। কারণ ওই; রকস্টার জেমসের ভূত চেপে আছে প্রিন্সের কাঁধে!ক্লাস সিক্স থেকে প্রিন্সের উপর জেমস যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেন তা ধীরে ধীরে যখন বাড়তে শুরু করলো তখন পরিবার সত্যি সত্যিই প্রিন্সকে নিয়ে আশঙ্কায় পড়ে গেলেন। পড়া লেখায় মন নেই প্রিন্সের। সারাদিন বন্ধু বান্ধব নিয়ে জেমসের গান শুনেন, জেমসের মতোন রাশভারি ভঙ্গি নিয়ে চলাফেরা করেন। যার ঘরভর্তি জেমসের বিভিন্ন ভিউকার্ড আর পোস্টার আর বিভিন্ন কাগজে জেমসের খবরের কাটিং। সব ছাপিয়ে গেল একদিন। বলা চলে এক মহা ঝামেলার কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেন প্রিন্স। নিজের মহল্লার পাশ দিয়ে যে রাস্তা গেছে সেগুলোর নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ‘জেমস রোড’। ছোট ছোট রোড মার্কে ‘জেমস রোড’ লিখে তা গলির মোড়ে মোড়ে ঝুলিয়েও দিলেন। তাতে বরং বয়ে আনলেন মহা বিপত্তি। থানা পুলিশের কাছে মুহূর্তে রাস্তার নাম নাম বদলের খবর চলে যায়। এমন দুঃসাহসিক কর্মের মাশুল নিতে দ্রুতবেগে পুলিশও চলে আসে। হাতেনাতে ধরে প্রিন্সকে। তার বাবা হয়তো পুলিশের হাত থেকে ছেলেকে রাখতে পারতো, কিন্তু তিনি ছেলেকে ছাড়াতে পুলিশকে কোনো অনুরোধ করলেন না। ভাবলেন কয়দিন গারদে থাকলে হয়তো শিক্ষা হবে। জেমসের ভূত হয়তো মাথা থেকে নামবে ছেলেটার। কিন্তু একরাত গারদে থাকলেও কোনো শিক্ষা হয়নি প্রিন্সের। বরং জেমসের প্রতি যেনো ভালবাসা আরো গাঢ় হলো তার, দৃঢ় হলো। যেনো এক মুহূর্তের জন্য প্রিন্স নিজেকে গুরু জেমসের গাওয়া ‘আমি জেল থেকে বলছি’র সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন...!প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে রকস্টার জেমসকে নিয়ে এক গ্রাম্য যুবকের এমন মাতামাতি আশপাশের অঞ্চলের কেউ ভালো চোখে দেখতো না। আক্ষরিক অর্থেই তাকে পাগল বলতো সবাই। তার এই পাগলামি দেখেই এক চাচাতো ভাই যিনি ঢাকায় থাকেন, তিনি যেনো কিভাবে একদিন মেনেজ করে দিলেন জেমসের ফোন নাম্বারটি। প্রিন্সের বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে কোনোদিন গুরুর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন তিনি। নিজ বিশ্বাস ভঙ্গ করেই একদিন কথা বললেন জেমসের সঙ্গে। আহা, সেকি আবেগঘন মুহূর্ত! এক গ্রাম্য যুবক আরাধ্য গুরু জেমসের সাথে কথা বলতে পারছেন, এই ধারনা থেকে এবার দেখা করারও ইচ্ছে পোষণ করেন প্রিন্স। নিয়মিত কথা বলার ফাঁকে সেটা ফোনে জানানও গুরুকে। কিন্তু সামনে এসএসসি পরীক্ষা। তার আগে হবে টেস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরুর আগেই গুরুর পা ছুঁয়ে সালাম করার বায়না ধরেন প্রিন্স। কিন্তু গুরু থামিয়ে দেন তার উচ্ছ্বাস! স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শিষ্যকে বলেন, ‘তুমি আমার সাথে এখন দেখা করতে আসবে না। আমি চাই পরীক্ষায় পাশ করে মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে আসো’। পড়ালেখার প্রতি খুব একটা মনোযোগ না থাকলেও গুরুর এমন কথায় প্রবল স্পৃহা খুঁজে পায় প্রিন্স। সত্যি সত্যিই পরীক্ষায় পাশ করে একদিন কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল হোসেনপুরের গ্রাম্য যুবক এসে দাঁড়ান উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা শিল্পী জেমসের বাড়ির সামনে। কিন্তু চাইলেইতো আর জেমসের সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিদিনই তার বাড়ির সামনে এমন অসংখ্য ভক্ত দাঁড়িয়ে থাকেন। নিরাপত্তারক্ষীদের বাঁধার মুখে টানা সাত ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকেন প্রিন্সও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাছোড়বান্দা প্রিন্সের কথা জানানো হয় গুরুকে। গুরু অনুমতি দেন। প্রথমবার সাক্ষাৎ হয় একজন রকস্টার ও সাধারণ এক ভক্তের! এ যেন মিলনের এক নন্দন কানন কিংবা  মহামঞ্চ। ভক্ত হিসেবে গুরুর সাথে যতোটা সখ্যতা হওয়ার ততোটাই প্রতিষ্ঠা করেন প্রিন্স মাহমুদ। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতাও বাড়তে থাকে আত্মিকভাবে। কিন্তু দুরত্ব তৈরি হতে থাকে পরিবারের সাথে। একজন শিল্পীকে নিয়ে পুত্রের এমন পাগলামিতে মায়ের সায় থাকলেও বরদাস্ত করতে রাজি নন প্রিন্সের বাবা। ফলে ঘর থেকে জেমস বিষয়ক সমস্ত কিছু বাইরে ফেলে দেয়া হয়। জেমসকে মেনে নিতে না পারায় বাবার সাথে তুমুল যুদ্ধ তখন। টানা দুই বছর বাবার সেই ঘরে ফেরেননি প্রিন্স। বন্ধু বান্ধব আর ভাড়া করা বাসায় থেকেছেন। ছোট ব্যবসা করে নিজের ব্যয় মিটিয়েছেন। অনেকেই বলবেন হয়তো এই ভালোবাসা, এই পাগলামির মানে কী। এর উত্তর নেই। ভালোবাসার বিনিময় হয় না। আর হলেও তা চোখে দেখা যায় না। দুনিয়া জোড়া এত কোটি ভক্ত থাকে জেমস এই একটা প্রিন্সকেই নিজের বুকে রেখেছেন ভালোবাসার বাঁধনে। যেখানে বাঘা বাঘা সব আয়োজক-কর্পোরেটরা জেমসের নাগাল পান না সেখানে প্রিন্স চোখ বন্ধ করলেই গন্ধ পান জেমসের বাঁকা হাসির, গুনগুন করা সুরেরও। আর চোখের দেখার বিনিময়ের কথা বলা যায়, অখ্যাত এক হোসেনপুরে গুরু জেমস চলতি বছরে দলে বলে গিয়েছেন। সেখানে গান করেছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রিন্সের সঙ্গে; তার বাড়িতে, জেমস রোডে। খেয়েছেন প্রিন্সের মায়ের হাতের রান্না। সমগ্র হোসেনপুরবাসী দেখেছে এক পাগলের অকৃত্রিম ভালোবাসার কী দারুণ প্রতিদান দিয়েছেন জেমস। সেই জেমস; যাকে নিয়ে বলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক মহেশ ভাট বলিউডের তারকাভরা মহা আসরে ঘোষণা দেন- এই উপমহাদেশে সত্যিকারের রকস্টার একটাই। সেটা জেমস। তার আগে এখানে রকস্টার আসেনি, পরেও আসবে কি না ভাবতে হবে। সেই জেমস; বিভাগীয় শহরগুলোতে গাওয়ার প্রস্তাব যিনি অনায়াসে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু হোসেনপুরের মতো মফস্বলে তিনি গিয়েছেন, গেয়েছেন শুধুমাত্র এক ভক্তের টানেই।যে বাবা জেমসের জন্য তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল সে ঘরেই জেমসের যাত্রা। এই প্যারাডক্সের কথা মনে করিয়ে সেই দুরন্ত অনুভূতির কথা জানতে চাইলে প্রিন্স অতীত টেনে বলেন, ‘গুরু জেমস আমার অক্সিজেন। তাকে সরিয়ে নিলে বাঁচা আমার সম্ভব নয়। অক্সিজেন ছাড়া কি মানুষ বাঁচতে পারে বলুন?’আসলেইতো। অক্সিজেন ছাড়া মানুষের কিভাবে বাঁচা সম্ভব! বাংলার রকস্টার জেমস বেঁচে থাকুন তার কোটি ভক্তের অন্তরে শিল্পের অক্সিজেন হয়ে, গানের রাজা হয়ে। বেঁচে থাকুক প্রিন্সের মতো ভক্তরাও। এলএ/পিআর

Advertisement