দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সদস্য দেশগুলোতে এখন ব্যাপক আলোচনা। ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও আফগানিস্তান সম্মেলনে যেতে রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় ১৯ তম সার্ক সম্মেলন স্থগিত হয়েছে। তিন দশকের ইতিহাসে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হওয়া কিংবা পিছিয়ে যাওয়াটা নতুন নয়। তবে একই দিনে চারটি দেশের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটা এবারই প্রথম। এই স্থগিত হওয়া পুরোনো খবর। প্রতিদিনের খবর হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা। গোলাগুলি, আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ করে বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমের খবরে আছে এই দুই দেশ। এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে যে, এই সংস্থাকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে করণীয় কী? একটা অভিমত উঠে আসছে এমন যে, পাকিস্তানকে ছাড়াই তবে এগুবে সার্ক?আট জাতি সমন্বয়ে গঠিত সার্কের অন্যতম দুই বড় রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের বৈরি সম্পর্কের কারণে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠান ও অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে বারবার। এবার আফগানিস্তান ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশও যৌক্তিক কারণে সম্মেলনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তান অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়ে আসছে। বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে পাকিস্তান যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ও দেখাচ্ছে, তা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক চরম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সার্কের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে শীর্ষ সম্মেলন বর্জন করা নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা; কিন্তু এছাড়া বাংলাদেশের বিকল্প কিছু ছিল না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বিরোধ চলছে এবং এই দুই দেশের সম্পর্ক এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, সংস্থা হিসেবে সার্কের টিকে থাকার বিষয়টিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অভিন্ন দক্ষিণ এশিয়ার পরিচয় তুলে ধরতে বাংলাদেশের উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করেছিল সার্ক। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শুরু, দীর্ঘ ৩১ বছর পরও সেটি মোটামুটি প্রতীকী সংগঠনই থেকে গেছে। সদস্য দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখলে ধারণা হবে, পাকিস্তানের কারণেই সার্ক সচল ও কার্যকর হতে পারছে না, পাকিস্তান এ অঞ্চলের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসী ও কট্টরপন্থি কার্যকলাপে মদদ দিয়ে দিয়ে। সার্কের সূচনা লগ্নে যে বিষয়টি ছিল, তা এখনো সবচেয়ে বেশি বিবেচনায়। আর তা হলো পিপল টু পিপল কন্ট্যাক্ট। মানুষে মানুষে এই যোগাযোগ, আঞ্চলিক সহযোগিতার বদলে যদি জঙ্গি আর সন্ত্রাসী কাণ্ডকে উসকে দেয় কোন দেশ, তাহলে করণীয় হবে তাকে বাদ দিয়েই এগিয়ে যাওয়া। ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, “এই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সব সদস্য দেশকে নিয়েই সার্ক-এ এগুতে হবে, এবং প্রয়োজনে কাউকে ছাড়াই”। ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে সার্কের বৈঠকে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে গোষ্ঠীভুক্ত সমস্ত দেশের মধ্যে মোটর ভেহিকেলস্ চুক্তি, আঞ্চলিক রেল সংযোগ, সন্ত্রাস-বিরোধী কাজকর্ম, বাণিজ্য করিডর গড়ে তোলা নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এগুলি যাতে দ্রুত বাস্তবায়িত হয়, সে জন্য উদ্যোগও ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের বাগড়ায় বাস্তবে কিছুই হয়ে উঠেনি। নেওয়াজ শরিফ বরাবরই জানিয়েছেন, এ সব বিষয়ে তাঁদের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে না। এক বছর অপেক্ষা করার পর ধীরে ধীরে পাকিস্তানকে বাদ দিয়েই ভারত-ভুটান-বাংলাদেশ-নেপাল (বিবিআইএন) করিডর, চাবাহার বন্দরের মাধ্যমে ইসলামাবাদকে এড়িয়ে সরাসরি আফগানিস্তানের সঙ্গে পণ্য সংযোগ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা শুরু করে ভারত। আর দিল্লির পরবর্তী পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্কের অন্য দেশগুলির সঙ্গে মিলে ‘টেররিস্ট অফেন্স মনিটরিং ডেস্ক’ ও ‘ড্রাগ অফেন্স মনিটরিং ডেস্ক’ তৈরি করা।সার্ক প্রতিষ্ঠার সময় কথা ছিল, দুই সদস্য দেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে সেখানে কোনও আলোচনা হবে না। এই প্ল্যাটফর্মে গুরুত্ব পাবে শুধুই আঞ্চলিক বিষয়। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলোকে, কাশ্মীর সমস্যাকে যে কোনও মাধ্যমে সব সময় তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, আর ভারত তা হতে দিতে চায়নি কখনোই। সার্ক সম্মেলন হয়নি, তাই সবার নজর এখন আগামী ১৫-১৬ অক্টোবরে ভারতে অনুষ্ঠেয় ব্রিকস-বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট ব্রিকস। এর বর্তমান চেয়ারম্যান ভারত। অন্যদিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাত দেশের কারিগরি ও অর্থনৈতিক জোট বিমসটেকের সদস্য বাংলাদেশ। বিমসটেকের দেশগুলো ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। এর বাইরে এ সপ্তাহেই নয়া দিল্লিতে আছে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনোমিক কোঅপারেশন (সাসেক) এর সভা যেখানে বসবেন ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলংকার প্রতিনিধিরা। পাকিস্তান ছাড়া এই সংস্থার মূল অর্থায়ন করবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি যে এর মধ্যেই অবকাঠামো ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ৭.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যদি সার্ক সদস্য দেশগুলোর দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগের দিকে লক্ষ্য করা যায়, তাহলেও চোখে পড়বে, পাকিস্তানের সাথে সেই অর্থে কারো কোন দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ নেই। কাষ্মীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ করছে পাকিস্তান। খোদ ভারতের সুশীল সমাজেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের সমালোচনা আছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই বিষয়টি উত্থাপন করেও ভাল সাড়া পাননি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ। লাইন অব কন্ট্রোলে ভারতের উড়ি সেনা ছা্উনিতে সন্ত্রাসী আক্রমণ করে ১৮ ভারতীয় সেনা হত্যার ঘটনা পাকিস্তানকে সেই সুযোগ দেয়নি। উল্টো সন্ত্রাসী কাণ্ডে পাকিস্তানের জড়িত থাকা বা তার মদদের কথাই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক, উভয় ক্ষেত্রেই পাকিস্তান এখন দক্ষিণ এশিয়ায় এক বিরূপ বিচ্ছিন্ন দেশ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি আঞ্চলিক সহযোগিতার কোন উদ্যোগই সফল করতে পারেনা দেশটির সেনাবাহিনী আর কট্টরপন্থিদের জন্য। বাস্তবতা এই যে, আফগানিস্তান পরে যুক্ত হয়েছে সার্ক-এ, হয়তো আগামীতে দেখতে হবে সার্ক থেকে চলে যেতে হয়েছে পাকিস্তানকে। এইচআর/এমএস
Advertisement