ক্রিকেট পুরোপুরিই পরিসংখ্যান ভিত্তিক একটি খেলা। ভাল খেললে পরিসংখ্যানেই ফুটে ওঠে। একইভাবে খারাপ পারফরমেন্সের রূপটাও পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশ যে আফগানিস্তানের সাথে এ সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ ভাল খেলেনি, স্কোরলাইনেই তার প্রমাণ। দুই ম্যাচের পরিসংখ্যানটা খুঁটিয়ে দেখলেই পারফরমেন্সের অনুজ্জ্বলতা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। প্রথম খেলায় ৭ উইকেট হাতে থাকার পরও শেষ ১০ ওভারে মাত্র ৬৯ রান যোগ করা এবং ওই ৭ উইকেট খুইয়ে ২৬৫ রানে থেমে যেতে হলো বাংলাদেশকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি রান তামিমের (৮০)। দ্বিতীয় সর্বাধিক (৬২) রান মাহমুদউল্লাহর। এছাড়া সাকিব করেন ৪৮ রান। এছাড়া ওয়ান ডাউন ইমরুল কায়েসের রান ৩৭। চার ইনিংসের যোগফল ২২৭। এর সঙ্গে অতিরিক্ত থেকে আসা ১২ রান জুড়ে দিলে দাঁড়ায় ২৩৯ রান। তার মানে বাকি ৭ ব্যাটসম্যান মিলে করলো ২৬ রান। বোলিংও অনুজ্জ্বল। সাকিব আল হাসান আর তাসকিন আহমেদ শেষ দিকে জ্বলে না উঠলে নির্ঘাত হারতে হতো। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যাটিং ব্যর্থতার সাতকাহন। মাত্র ২০৮ রানে ইনিংস শেষ। যার ৪৩ রান শেষ জুটিতে অভিষেক হওয়া তরুণ মোসাদ্দেক আর পেসার রুবেল হোসেনের জুড়ে দেয়া। ঘরের মাঠে গত চার সিরিজে দুর্দান্ত পারফর্ম করে ১২ ম্যাচ জেতা টাইগারদের শেষ ১৪ ওয়ানডেতে এটা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (২০৮) স্কোর। এর আগে গত ১০ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে শেরে বাংলায় ১৬০ রানে অলঅআউট হয়েছিল মাশরাফির দল। ওই ম্যাচে ব্যাটিংয়ের জীর্ন দশা। একজন ব্যাটসম্যানও পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছুতে পারেননি। সর্বোচ্চ ৪৫ মোসাদ্দেকের। এত অল্প পুঁজি নিয়ে আর শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁ-হাতি স্পিনার সাকিব ( ৪/৪৭) ও অভিষেক হওয়া মোসাদ্দেক তার অফস্পিন ( ২/৩০) দিয়ে প্রাণপন চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি। ২ উইকেটের হার সঙ্গী হয়ে যায়। এ ম্যাচেও বোলিং দৈন্যতা ফুটে ওঠে। শুরুতে আফগানদের চাপে ফেলেও সে চাপ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ৬৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে যখন অনিশ্চিত অবস্থা থেকেও অধিনায়ক আসগর স্ট্যানিকজাই ও মোহাম্মদ নবির পঞ্চম উইকেটে জুড়ে দেয়া ১০৭ রানেই জয়ের ভীত গড়ে ওঠে আফগানদের। পরিসংখ্যান সুস্পষ্ট সাক্ষী, কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত পারফরমেন্স দ্যুতি ছড়িয়েছে; কিন্তু পুরো দল ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে এক সঙ্গে জ্বলে উঠতে পারেনি। মোদ্দা কথা, টিম পারফরমেন্স হয়নি। এই না হওয়াটা দুঃখের। হতাশার। যন্ত্রনারও। তাই বলে ভেঙ্গে পড়ারও কিছু নেই। মনে রাখতে হবে এ সিরিজে মাশরাফি বাহিনীর যে জীর্ন দশা, সেটাই তাদের প্রকৃত রূপ নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি ভাল খেলার সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের। রেকর্ডও তাই বলে দিচ্ছে। ইতিহাস-পরিসংখ্যান সে সত্যই জানান দিচ্ছে। ইতিহাস জানাচ্ছে, এই বাংলাদেশ, এই মাশরাফি বাহিনীই এক বছরেরও কম সময় আগে ঘরের মাঠে পর পর চার চারটি সিরিজ জিতেছে। যার তিনটি ক্রিকেটের তিন পরাশক্তি ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানা, মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ওই তিন দলের সাথে আসগর স্ট্যানিকজাই, মোহাম্মদ নবি, মোহাম্মদ শাহজাদ ও হাশমতউল্লাহ ও রশিদ খানদের কোন তুলনাই চলে না। পাকিস্তানকে তিন ম্যাচের সিরিজে ধবল-ধোলাই দিয়ে শুরু টাইগারদের দুর্দমনীয় হয়ে ওঠা। তারপর ভারতের সাথে প্রথম দুই ম্যাচ জিতেই সিরিজ নিজেদের করে শেষ ম্যাচে হেরে ২-১। আর দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে প্রথম ম্যাচ হারার পরও পরের দুই ম্যাচে অনমনীয় দৃঢ়তায় সিরিজ জয়। আর সর্বশেষ গত নভেম্বরে তিন ম্যাচ সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করা। সেই চার সিরিজে টাইগারদের হুঙ্কার-গর্জন আর শৌর্য্য-বীর্য্যে কাছে নাকাল ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বাঘা বাঘা পারফরমাররাও। ওই সিরিজগুলোয় ব্যক্তিগত পারফরমেন্স ছিল দারুণ। সেখানে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম, সাকিব আল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সাব্বির রহমান এবং অধিনায়ক মাশরাফি রং ছড়িয়েছেন। তামিম ও মুশফিক দুটি করে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। সৌম্যও পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ ম্যাচে দুর্দান্ত শতক (১১০ বলে ১২৭) এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এক ম্যাচে বিধ্বংসী ব্যাটিং করেন। সাব্বির, মাহমুদউল্লাহ সেঞ্চুরি করতে না পারলেও প্রয়োজনের সময় কার্যকর অবদান রেখেছেন। বোলিংটাও হয়েছে তেমনি। পেসার ও স্পিনাররা মিলে ভাল বল করেছেন। সময়মত ব্রেক থ্রু এসেছে। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা কোন সময়ই চেপে বসতে পারেননি। কিন্তু এবার আফগানিস্তানের সাথে তা হয়নি। সে না হওয়ার কারণেই সিরিজ এখন ১-১। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ তার সামর্থ্যের অর্ধেকও খেলেনি; কিন্তু আফগানরা সামর্থ্যের সেরাটা দিয়ে খেলে ফেলেছে। শনিবার তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে যারা বাংলাদেশের পরিনতি নিয়ে চিন্তিত, তারা শুধু এই কথা ভেবেই আশাবাদী হতে পারেন। মাশরাফির দল খুব খারাপ খেলছে। নিজ সামর্থ্যের ৪০-৫০ ভাগ পারফর্ম করেছে। এখন দরকার সেই পারফরমেন্সের গ্রাফট টেনে ওপরে নিয়ে আসা। টাইগাররা সামর্থ্যের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ উপহার দিতে পারলে অনায়াসে আফগান বধ সম্ভব। খালি চোখে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও আফগান্তিান সমানে সমান। ওয়ানডেতে জয় পরাজয়ের অনুপাত সমান সমান ২:২। তবে একটা সমীকারণ আছে। খুব বেশি দুরে যাবার দরকার নেই। টিম বাংলাদেশ ভক্তরা সবাই ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচকে অনুপ্রেরণার প্রতীক ভাবতে পারেন। ওই ম্যাচেই প্রমাণ হয়েছে দু`দলের প্রকৃত সামর্থ্য ও শক্তি। দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী। অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরার ম্যানোকা ওভালে প্রমাণ হয়েছে টাইট বোলিং আর আফগান ব্যাটিং লাইনআপের ওপর শুরু থেকে চাপ সৃষ্টি করে তা ধরে রাখতে পারলে ২৬০ প্লাস রান খুবই ভাল স্কোর। ওই ম্যাচে সাকিব (৬৩)-মুশফিকের (৭১) বুক চিতানো ব্যাটিংয়ের যোগফল ২৬৭। তারপর অধিনায়ক মাশরাফির প্রথম ওভারে ব্রেক থ্রু। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া (২০ রানে ৩ উইকেট)। তার পাশাপাশি দুই পেসার রুবেল-তাসকিনের ব্যাকআপ এবং স্পিনার সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর স্পিন ঘূর্ণ। এক মুহুর্তর জন্য আফগানদের স্বস্তিতে ব্যাট করতে না দেয়া। আর তাতেই ১৬২‘তেই তারা অলআউট। শেষ কথা তামিম, সৌম্য, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও সাব্বিররা গত দেড় বছরের বেশি সময় যেমন ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলেছেন, সবাই না হোক- দুই থেকে তিনজন তেমন খেললেই স্কোরলাইন ২৭০‘র আশপাশে থাকবে। তারপরের কাজটা বোলারদের। প্রথম থেকে আফগানদের পিছনের পায়ে ঠেলে দিতে হবে। তারপর তারা যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে চাপটাও রাখতে হবে। তাহলে আর চিন্তা থাকবে না। বিশ্বকাপের মতই হয়ত শতরানের ব্যবধানের বড় জয় ধরা দেবে টাইগারদের হাতের মুঠোয়। এআরবি/আইএইচএস/পিআর
Advertisement