মতামত

হায় রে সেলফি

দারুণ সুদর্শন এক তরুণ। তার প্রেমে পাগল তরুণীরা। কিন্তু কারও দিকে তার নজর নেই। সে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখতেই বেশি ব্যস্ত। এই সুন্দর ছেলেটির প্রেমে পড়ে বনদেবী ইকো। কিন্তু দেবরানী হেরার শাপে সে নিজে কোনো কথা বলতে পারে না শুধু অন্যের কথার শেষ শব্দটির প্রতিধ্বনি করতে পারে।  ইকো একদিন আকারে ইঙ্গিতে প্রেম নিবেদন করে ছেলেটিকে। কিন্তু অহংকারী তরুণ তার সেই বোবা ভালোবাসাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চলে যায়। ভালোবাসার এই অবমাননায় প্রেমের দেবী ভিনাস অভিশাপ দেন তরুণকে। একদিন ঝর্নার জলে নিজের ছায়া দেখে নিজেরই সুন্দর রূপের প্রেমে পড়ে যায় সে। অপলক চেয়ে থাকে নিজের চেহারার দিকে দিনের পর দিন। অবশেষে একদিন নিজের প্রতিচ্ছবির পাশেই মৃত্যু হয় তার। গ্রিক পুরানের নার্সিসাস নামে হতভাগ্য এই যুবকের কাহিনীটি অনেকেরই জানা। এই কাহিনী থেকেই আত্মপ্রেমী মানুষকে বলা হয় নার্সিসাস। গ্রিক পুরাণের যুগে যদি মোবাইল ফোন আর সেলফি থাকতো তাহলে নার্সিসাস ঝরণার জলে নিজের ছায়া দেখে নয়, ফোনের স্ক্রিনে সেলফি তুলতে তুলতে পানিতে পা পিছলে পড়ে  প্রাণ হারাতেন। আমাদের চারপাশে এখন নার্সিসাসদের ছড়াছড়ি।কবরস্থানে দাফন হচ্ছে বোনের মৃতদেহ। সেই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সেলফির জন্য পোজ দিচ্ছে ভাই। পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে কবরখোদকরা। তাদেরও মুখে হাসি। এমন নির্বোধ নিষ্ঠুর দৃশ্য জীবনে কমই দেখেছি। সেলফি তুলতে গিয়ে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনাও সাম্প্রতিক। আত্মহত্যার আগে গলায় দড়ি জড়িয়ে সেলফি তোলার ঘটনাও সম্প্রতি ঘটেছে।  সেলফি তুলতে গিয়ে অনেক ধরনের দুর্ঘটনায় সারা বিশ্বেই প্রাণ হারিয়েছে অনেক মানুষ। ফেসবুক খুললেই দেখা যায় হাসিমুখে, প্যাঁচামুখে, হাঁসের মতো মুখে, নানা রকম ভাবে ভঙ্গিতে তোলা সেলফি। কয়েকজন তো আবার সেলফি ভিডিও আপলোড করেন। এই আধুনিক নার্সিসাসরা সেলফি আপলোড করেন আর মিনিটে মিনিটে খোঁজ করেন ক’টি লাইক, কমেন্ট পড়লো। কিন্তু কেন সেলফির এমন মহামারী?  নিজের ছবি নিজে তোলার জন্য এত বাড়াবাড়িই বা কেন? কারণটি অতি পরিষ্কার। আমরা দিনের পর দিন একা হচ্ছি, নিঃসঙ্গ হচ্ছি এবং আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছি। সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আপনারে শুধু হেরিয়া হেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে’। সত্যিই ‘নিজেরে করিতে গৌরবদান, নিজেরে কেবলি করি অপমান’। আমরা নিজের প্রচার করতে গিয়ে আসলে নিজেকেই অপমান করছি, নিজেকে খেলো করছি, সস্তা করছি।সেলফি হলো মানুষের নিঃসঙ্গতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার  চূড়ান্ত নিদর্শন। শুধু তাই নয়, আত্মবিশ্বাসহীনতারও  পরিচায়ক। কারণ নিজের চেহারা নিজে দেখে শান্তি নেই। অপরে দেখুক, প্রশংসা করুক, লাইক দেক, কমেন্ট করুক। তবেই না শান্তি। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার এই সেলফিকে প্রমোট করছে। কারণ তারা ভাবছে স্রোতের তালে গা ভাসালেই লাভ। মানুষের এই নার্সিজমকে পুঁজি করে যদি দু’পয়সা ফায়দা লোটা যায় তো মন্দ কি।সত্যি বলতে কি সেলফি তোলার এই প্রবণতা প্রমাণ করে যে আমরা সামাজিকভাবে ক্রমশ একা হচ্ছি, নিঃসঙ্গ হচ্ছি। আজ এত এত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ঠেলায় আমরা পাশের ফ্ল্যাট তো দূরের কথা পাশের ঘরের মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগ করতেও ভুলে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বাড়ছে দূরত্ব। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কে জঙ্গির খাতায় নাম লেখাচ্ছে আর কে ইয়াবা সেবন করছে আর কে মোবাইলে অসুস্থ ভিডিও দেখছে তার কোনো খোঁজ আমরা রাখছি না। আমরা ভার্চুয়াল জগতের মানুষদের মেকি প্রশংসার লোভে অ্যাকচুয়াল জগতের বন্ধুদের হারাচ্ছি, হারাচ্ছি স্বজনদের।আমি প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নই। প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রায় আরও গতির সঞ্চার করেছে। কিন্তু সেই গতি নিয়ন্ত্রণের রিমোট কন্ট্রোলটিও আামাদের হাতে থাকা প্রয়োজন। এবং সেই রিমোট কন্ট্রোল আমরা যেন ঠিকভাবে সুস্থতার সাথে ব্যবহার করতে পারি সেটাও দেখা প্রয়োজন। আত্মকেন্দ্রিকতার এই খোলস ছেড়ে আমাদের বের হতে হবে। নিজেকে দেখা নয়, নিজের প্রেমে মশগুল হওয়া নয়, প্রয়োজন সমাজ সচেতনতার। প্রযোজন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা। আমাদের প্রধান সমস্যা এখন মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ। আমাদের প্রধান সমস্যা এখন নারীর প্রতি সহিংসতা। আমাদের সমস্যা সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের সমস্যা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। আমাদের এখন সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে ভার্চুয়ালির চেয়ে অ্যাকচুয়ালি। আত্মকেন্দ্রিক নয়, সমাজকেন্দ্রিক হতে হবে আমাদের।নার্সিসাসরা সকল যুগে, সকল সমাজেই করুণার প্রাত্র। ‘আপনারে লয়ে বিব্রত থাকা’র সময় নেই। একা একা নয় দলবদ্ধভাবে সামাজিক মূল্যবোধগুলো ফিরিয়ে আনার চর্চা করতে হবে। মুঠোফোনের মুঠোর ভিতর নিজের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত না করে  আশপাশের মানুষের দিকে চোখ মেলে তাকাতে হবে। আগে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল, লাইব্রেরি ছিল, সাংস্কৃতিক দল ও সংগঠন ছিল। স্কুলে কলেজে বয়স্কাউট, গার্লস গাইডদের দেখা মিলত। সমাজের কাজ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক ছিল। সেসব আবার ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায একে বলা হয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ।এই সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এখন খুব বেশি প্রয়োজন। আমরা বাঙালি। তিন হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতিবান জাতি। বিশ্বকে উপহার দিয়েছি মানবতার দর্শন। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই এমন মানবতার কথা প্রথম উচ্চারিত হয়েছে আমাদেরই কণ্ঠে। বাংলার সহজ সাধন, নাথপন্থা, বৈষ্ণব, বাউল, সুফিবাদের মানবপ্রেমের দর্শন পুনর্জাগরিত করতে হবে।স্বার্থপরতা, আত্মপ্রেম আর বিচ্ছিন্নতার  বলয় থেকে বের হয়ে আমাদের এখন সত্যিকারভাবে সমাজবদ্ধ হতে হবে। মানবতার কল্যাণে, জাতির কল্যাণে, বিশ্বের কল্যাণে যারা কাজ করেন তাদের ছবি তোলার লোভও থাকে না, আবার তাদের ছবি তোলার জন্য লোকেরও অভাব হয় না। তাদের আত্মবিধ্বংসী সেলফি তোলার প্রয়োজন হয় না।লেখক : কবি, সাংবাদিকএইচআর/এমএস

Advertisement