“মৌলবাদীরা আমাদের ভয় পায় তাই আমাদেরকে খুন করছে”- নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টারের কাছে এমনটাই বলেছেন নাহিদ হাত্তারকে হত্যার প্রতিবাদে সামিল হওয়াদের একজন। জর্ডানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাহিদ হাত্তারকে প্রকাশ্য দিবালোকে বুলেটবিদ্ধ করা হয়েছে এবং তাও আবার আদালতের সামনে। তিনি এসেছিলেন আদালতে হাজিরা দিতে, তার বিরুদ্ধে ইসলাম-অবমাননার মামলা চলছিলো। হাত্তার তার ফেসবুকে একটি কার্টুন শেয়ার করেছিলেন এবং তার প্রতিবাদ হওয়ায় তিনি সেটি প্রত্যাহার করেন এবং বলেন যে, তিনি ধর্ম অবমাননার জন্য এই কার্টুনটি শেয়ার করেননি। বরং তিনি এই কার্টুনের মাধ্যমে তথাকথিত আইসিসকে আঘাত করতে চেয়েছেন, কারণ তারা এরকম বেহেশতের কথাই বলে থাকে। এক বৃদ্ধ দু’জন নারীর সঙ্গে শুয়ে থেকে ঈশ্বরকে বলছেন আরো পানীয় ও খাবার নিয়ে আসার জন্য, কার্টুনটিতে এর বেশি কিছুই ছিল না। অথচ সে জন্য হাত্তারকে প্রাণ দিতে হলো। ধর্ম এখন এতোটাই রক্ত পিপাসু হয়ে উঠেছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ এরকম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছি ২০১৩ সাল থেকে, যখন ধর্ম অবমাননার দায়ে ব্লগার রাজীবকে হত্যা করা হয়েছিল। তারপরতো একের পর এক লাশ পড়েছে, বাংলাদেশের ধর্মবাদের উল্লম্ফন দেখেছি আমরা, দেখেছি কী করে রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে ধর্ম। আজ সকালে যখন পৃথিবীর গণমাধ্যম নাহিদ হাত্তারের রক্তাক্ত শরীর প্রদর্শন করছিলো তখন যে কোনো সুস্থ বিবেকের মনেই ধর্ম সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জেগে ওঠার কথা, কারণ, ধর্ম যদি এতোটাই রক্ত পিপাসু হয়ে থাকে তাহলে তাকে কী ভাবে মানবতার জন্য, মানুষের জন্য কল্যাণময় বলে মেনে নেওয়া যায়? নাহিদ হাত্তার জর্ডানের নাগরিক, খ্রীস্টান পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি নিজেকে দাবি করেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে। তিনি নিয়মিত লিখতেন লেবাননের একটি পত্রিকায়, যেখানে তার লেখার বিষয় ছিল মূলতঃ আইসিস-এর সমালোচনা করা। জর্ডানের প্রতিবেশি রাষ্ট্র সিরিয়ায় যখন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছে তখন জর্ডান নিজেকে সব সময় “যুদ্ধ-নিরপেক্ষ” রাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করে থাকে যদিও বলা হয়ে থাকে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে এই যুদ্ধ-নিরপেক্ষতার মূল্য হিসেবে ওয়াশিংটন দেশটিকে কয়েক বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে থাকে। এও পৃথিবী জানে যে, আরব বিশ্বে যে ক’টি রাষ্ট্র একটু একটু করে গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে চাইছে তার মধ্যে জর্ডানের নাম রয়েছে। কিছুদিন আগেই সেখানে নির্বাচনে ২০ জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, যাকে আরব-বিশ্বে নজির হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ২৩০টি আসনের মধ্যে ১৫টি আসন লাভ করেছে কট্টর মৌলবাদী সংগঠন, যাদের সঙ্গে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে বিচারালয়ের সামনে বিচারাধীন নাগরিককে গুলি করে হত্যা কোনো সভ্য দেশের ঘটনা হতে পারে না। কিন্তু জর্ডানে হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের, গ্রেফতার করা হয়েছে স্থানীয় একজন ইমামকে। যে ইমাম মনে করে নাহিদ হাত্তারকে ব্ল্যাসফেমি আইনে বিচার যথেষ্ট নয়, তাকে হত্যা করাই শ্রেষ্ঠ বিচার এবং সে সেটাই করেছে যেটার নির্দেশ তার ধর্মে রয়েছে। নাহিদ হাত্তার যখন তার ফেসবুক পাতায় আলোচ্য কার্টুনটি প্রকাশ করেছিল তখন তার বিরুদ্ধে যখন মৌলবাদীরা খেপে উঠেছিল তখন সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে ব্ল্যাসফেমি আইনে মামলা দেওয়া হয়। এখন হাত্তার সমর্থকরা বলছে যে, এই হত্যকাণ্ডের জন্য আসালে সরকার নিজেই দায়ী। কারণ, যে কার্টুনটি হাত্তার ফেসবুকে শেয়ার করা হয়েছিল তা কোনো ভাবেই ধর্মকে আঘাত করে করা হয়নি এবং সে জন্য হাত্তার ক্ষমাও চেয়েছিলেন, তাহলে কেন তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে প্রকাশ্যে মৌলবাদীদের টার্গেট করা হলো? যদিও এরকম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জর্ডানের সরকার অভ্যস্ত নয়। শুধু জর্ডান কেন, কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রই কি অভ্যস্ত? বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই তাহলে কি একই চিত্র দেখতে পাই না? এ যাবত ধর্ম রক্ষার নামে যতো ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে ঢিমে তেতালায় সেসব হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চলছে, এখনও হত্যাকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ধর্মের নামে এসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বড় কোনো সামাজিক আন্দোলন এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এটা বোধ করি সম্ভবও নয় কারণ বাংলাদেশেও হাত্তারের হত্যাকারী ইমামের মতোই অনেক কট্টরচিন্তার মানুষ রয়েছে, যারা ধর্মকে মানুষের আগে স্থান দেয়, যারা মনে করে যে, ধর্মের জন্যই মানুষ, মানুষের জন্য ধর্ম নয়। আর দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলি এই কট্টরপন্থী মানুষগুলোকে ভয় পায়, ভোট হারানোর ভয়। সমস্যাটা আসলেই সেখানে। তবে সমস্যা আরো কিছু জায়গায় আছে। ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশকে যখন মোটাদাগে বিভক্ত করা হলো ধর্মের ভিত্তিতে, তখন হঠাৎ একদল বকেয়া-বাম দাঁড়িয়ে পড়লেন, যারা মূলতঃ ওই ধর্মবাদীদের মুখপাত্র হয়ে উঠলেন রাতারাতি। তারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেন না কিন্তু প্রকাশ্যে উদারপন্থী সেক্যুলারদের সমালোচনা শুরু করলেন। তারা একটি দেশের ক্রমশঃ ধর্মের ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত ‘সেনসিটিভ’ হয়ে ওঠাকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের সুযোগ খুঁজতে লাগলেন এবং পেয়েও গেলেন গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে হেফাজতকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে। বেগম খালেদা জিয়া ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সুরে সুর মিলিয়ে এই ভণ্ডরাও ‘সেক্যুলার’ শব্দটিকে একটি গালিতে পরিণত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সেক্যুলারদের গালি দিয়ে তারা নিজেরা কীসে পরিণত হচ্ছে সে প্রশ্ন তাদেরকে করলে তারা হয় গালি দিয়ে প্রশ্নকারীকে থামিয়ে দেন, না হয় নীরব থাকেন। তাদের জীবনাচরণ কিংবা পোশাক-আশাক কোনো কিছুতেই তাদেরকে ধর্মাশ্রয়ী হিসেবে চেনার উপায় নেই তাই খুব সহজভাবেই তারা নিজেদেরকে ভীড়ে লুকিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়, এরাই হবে আগামী দিনের রক্তপন্থী ধর্মরক্ষাকারী। এবং বাংলাদেশ যে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ক্রমশঃ তাতে এরা হবে বুদ্ধি-সেনানী। ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ হত্যাকাণ্ডের জন্য যাদেরকে এই মুহূর্তে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে তাদের নেতৃত্ব ও নির্দেশদাতা হিসেবে মূলতঃ বিচার হওয়া উচিত বেগম জিয়া ও মাহমুদুর রহমানের। এবং তার পরবর্তী ধাপেই আসবে এইসব পতিত বামদের নাম, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে রক্তপিপাসু ধর্মবাদীদের ক্রমাগত উস্কে চলেছে।আজ সকালেই যখন নাহিদ হাত্তারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানাবিধ বিশ্লেষণ চলছিলো বৈশ্বিক গণমাধ্যমে তখন ওপরের কথাগুলি মাথায় আসছিলো এই হত্যাকাণ্ডের বাংলাদেশ-প্রেক্ষিত নিয়ে ভাবনায়। বাংলাদেশ জর্ডান নয়, নয় মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশ। বাংলাদেশের মানুষের ভেতর গণতান্ত্রিক চেতনা ও রাজনৈতিক বোধ এখনও তীব্র। তাই রাষ্ট্র-বিরোধী শত প্ররোচনায়ও বিএনপি-জামায়াত জোট কাউকে পাশে পায়নি, মানুষ হত্যা ও ধর্মের নামে রক্তপাতে কেবলমাত্র তাদেরকেই পাশে পেয়েছে যারা আসলে রক্তপিপাসু ও ধর্মকে মানুষের ওপরে স্থান দিয়ে থাকে। সে বিচারে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সিরিয়ার আইসিস-এর রাজনীতির কোনো পার্থক্য নেই, বরং যতোই দিন যাচ্ছে ততোই একথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, আইসিস-এর সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে জামায়াতই ধর্মের তলোয়ারে রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল চাইছে। এমনকি তাদের পক্ষে গলা ফাটিয়ে উদাপরন্থীদের দিনরাত গালাগাল দেওয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সেলিব্রেটিরাও ব্যর্থ হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করতে। খুব কৌশলে উন্নয়নকে ধর্মের বিরুদ্ধে নেওয়ার চেষ্টাতেও তারা সমান ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বরং এক্ষেত্রে সরকার খুব সফলভাবে উন্নয়ন ও ধর্মকে সমান্তরালভাবে পাশে রেখে কাজ করে যাচ্ছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে সরকার ধর্মকে সুরক্ষার জন্য উদাপরন্থীদের বিরুদ্ধাচার করছে বলে মনে হয় কিন্তু তারপরও সরকারকে ধর্মবিরোধী হিসেবে প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা থেমে নেই। নাহিদ হাত্তারের হত্যাকাণ্ডের মতো বাংলাদেশেও সরকারের ধীরে চলো নীতির কারণে আমরা বাংলাদেশকে রক্তাক্ত হতে দেখেছি। দেশ ছাড়তে হয়েছে অনেককে। একথা সত্য যে, এই ধর্মদানব বধ রাতারাতি সম্ভব নয়। কোনো দেশেই সেটা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় উগ্রবাদ বর্তমান পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এই দানব বধে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে জন্য সকল পক্ষের যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন তার অনুপস্থিতি অত্যন্ত হতাশাজনক। সরকার যখন এই উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর হয় তখন তথাকথিত উদারপন্থীরা সরকারের সমালোচনা করেন আবার যখন উগ্রবাদীরা দেশকে রক্তাক্ত করে তখনও সরকারকে আঘাত করেন এই তথাকথিত উদারপন্থীরা। সেই কলা “ছিলা এবং বুজিয়ে” দেওয়ার মতো পরিস্থিতি, সন্ত্রাসীদের হত্যা করা হলো কেন? আবার সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যা করলে সে দোষও সরকারের। তবে সুখের কথা হলো, এই দোষারোপের সংস্কৃতি এখন টক শো আর ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষ এসবে নেই, তাদের জীবনকে সরকার কতোটা নিরাপত্তা দিতে পারছে তারা সেটা নিয়েই চিন্তিত, তার বেশিতে আর কেউ আগ্রহী নয়। আগেই বলেছি যে, বাংলাদেশ জর্ডান নয়, কিন্তু বাংলাদেশকে জর্ডান বানানোর চেষ্টা বহু আগেই শুরু হয়েছে। নাহিদ হাত্তারের মতো বাংলাদেশের মাটিও রক্তাক্ত হয়েছে উদাপরন্থীদের রক্তে। কিছু বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী এই রক্তপিপাসুদের পক্ষ নিয়েছে, সেক্যুলারদের টার্গেট হিসেবে দেখিয়ে দিচ্ছে ধর্মোন্মাদদের। অথচ তারা বুঝতেই পারছে না যে, ধর্মকে তারাই আসলে রক্তপিপাসু করে তুলছে ক্রমাগত। আর দেশে দেশে নাহিদ হাত্তাররা খুন হচ্ছে এই রক্তপন্থীদের হাতে। পৃথিবীর সকল ঘৃণা এই রক্তপন্থী ধর্মবাদীদের জন্য এবং তাদের সমর্থন ও বুদ্ধিদাতা নব্য প্রগতিবাদীদের জন্য- সেটা বাংলাদেশেই হোক আর জর্ডানেই হোক। রচেষ্টার ৬ সেপ্টেম্বর, সোমবার ২০১৬লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্টmasuda.bhatti@ gmail.com এইচআর/এমএস
Advertisement