বিনোদন

‘আমি তো এখন আর নই কারো’

নতুন প্রজন্মের অনেক দর্শকের কাছেই তার নামটি অজানা। সংগীতে প্রতিষ্ঠা পেতে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছিলো তাকে। তারপর এলেন চলচ্চিত্রে। এখানেও তীব্র প্রতিযোগিতার ভিড়ে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার ডাক শুনে অস্ত্র হাতে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধেও। জীবন তার অনেক সংগ্রামের রঙে রঙিন।কিন্তু আফসোসের বিষয়, যখনই ঢাকাই সিনেমার আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলে উঠলেন তখনই মৃত্যু কেড়ে নিল সব আলো। এতক্ষণ ধরে বলছিলাম চিরসবুজ চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের কথা। আজ ২৫ সেপ্টেম্বর তার জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে তিনি এবার ৫৭ বছরে পা রাখতেন। ঢাকাই ছবিতে জাফর ইকবাল ছিলেন সত্তর ও আশির দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় হার্টথ্রুব নায়ক। বিশেষ করে রোমান্টিক দৃশ্যে তার উপস্থিতি নাড়িয়ে যেত তরুণীদের হৃদয়। তাকে স্টাইল আইকন হিসেবে নিয়েছিলেন সেসময়ের তরুণরা। এমনকি তার পরবর্তী জেনারেশনের নায়করাও তার ফ্যাশন অনুসরণ করেছেন।তাকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করে খুব সহজেই লাভবান হতেন পরিচালক ও প্রযোজকরা। অথচ সময়ের স্রোতে জাফর ইকবাল ভেসে গেলেন দুর্বল স্মৃতির ঢেউয়ে। তার জন্মদিন, মৃত্যুদিন চলে যায় নীরবে, মনে রাখে না কেউ। না ফেরার দেশে বসে অকৃতজ্ঞ চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি, কাজের সহকর্মী আর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হয়তো নিজের গাওয়া গানটিই বেশি করে মনে পড়ে তার- ‘আমি তো এখন আর নই কারো’!জাফর ইকবাল জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে। বাড়িতে গান-বাজনার রেওয়াজ ছিল। তার বোন শাহানাজ রহমতুল্লাহ একজন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজও নামকরা শিল্পী। ভাই ও বোনের মতো জাফর ইকবালও প্রথমে গায়ক হিসেবেই পরিচিতি পান। স্কুল, ক্লাবের কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই গিটার বাজিয়ে গান গাইতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি নিজের একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন। ‘পিচঢালা পথ’ সিনেমায় তিনি প্রথম গান করেন। ‘বদনাম’ ছবিতে তার কণ্ঠে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে অমর সৃষ্টি হয়ে আছে। চলচ্চিত্রের বাইরে তার গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘যেভাবে বাঁচি, বেঁচে তো আছি’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি রুনা লায়লার সঙ্গে ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’ গানটিতে কণ্ঠ দেন। জাফর ইকবাল আমৃত্যু একজন গায়ক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আনন্দবোধ করেছেন।আর চলচ্চিত্রে তার আগমন ঘটে মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে কবরীর বিপরীতে ‘আপন পর’ ছবিতে অভিনয় করে। সেটিই তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন জাফর ইকবাল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। ‘সূর্যসংগ্রাম’ ও এর সিকুয়্যাল ‘সূর্যস্বাধীন’ চলচ্চিত্রে ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালের ‘মাস্তান’ ছবিটি তাকে সে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ। ধীরে ধীরে সামাজিক প্রেমকাহিনী ‘মাস্তানে’র নায়ক জাফর ইকবাল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এক গ্রামীন তরুণের চরিত্রেও দর্শক তাকে গ্রহণ করে দারুণভাবে। কারিয়ারে জাফর ইকবাল ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। যার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। ১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। এ ছবিতে চম্পা ও ববিতা- দুই বোনের বিপরীতে তার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ববিতার সঙ্গে তার জুটি ছিল দর্শক নন্দিত। এই জুটির বাস্তব জীবনে প্রেম চলছে বলেও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় হতাশ হয়েই জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান বলে জোর গুঞ্জন উঠেছিল। ববিতার বিপরীতে ৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।জাফর ইকবাল অভিনীত ‘ভাই বন্ধু’, ‘চোরের বউ’, ‘অবদান’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘবিজলী বাদল’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘নয়নের আলো’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’ ,‘সন্ধি’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র সুপারহিট হয়। আশির দশকের শুরুতে তার ক্যারিয়ার নানা কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি ছিলেন বেশ খামখেয়ালী, আবেগপ্রবণ এবং দারুণ অভিমানী। অনিয়মিত জীবনযাপন ও অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তার হৃদযন্ত্র ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাফর ইকবালের ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগনে তখন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৯১ সালে ২৭ এপ্রিল মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই থেমে গেল ঢাকাই চলচ্চিত্রের রুপকথার যুবরাজের গল্প। সূত্র : অনলাইনএলএ/আরআইপি

Advertisement