দেশজুড়ে

সাগরে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ

ইলিশের আকাল, প্রজনন মৌসুমে শিকারে নিষেধাজ্ঞা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলদস্যুদের উৎপাত-অপহরণসহ সব মিলিয়ে আগের কয়েক মৌসুম মোটেই ভালো কাটেনি উপকূলীয় জেলেদের। কিন্তু মাসখানেক ধরে সাগর ও নদীতে অন্য সময়ের তুলনায় অধিক রূপালি ইলিশ ধরা পড়ায় হাসি ফুটেছে দুর্দশাগ্রস্ত জেলে ও ট্রলার মালিকদের মুখে। আবার কম দামে ইলিশ কিনতে পারায় খুশি ক্রেতারাও। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সমুদ্র থেকে ইলিশ শিকার করে আসা ট্রলারগুলো সারিবদ্ধভাবে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে নোঙর করে আছে। নোঙর করা প্রতিটি ট্রলারের খন্দ (ট্রলারে মাছ সংরক্ষণ করার বাক্স) থেকে দু-তিনজন জেলে বের করছেন ইলিশ।অন্য জেলেরা এই মাছ থেকে ছোট-বড় ইলিশ আলাদা করে ঝুড়িতে তুলে দিচ্ছেন। এসব ঝুড়ি ঘাট শ্রমিকরা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। আর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ভেতরের শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিক্রি হওয়া এসব ইলিশ প্যাকেট করতে। অন্যদিকে আরেক দল শ্রমিক প্যাকেট করা এসব ইলিশ তুলে দিচ্ছিল ট্রাকে। ঘাট শ্রমিক থেকে শুরু করে পাইকার পর্যন্ত দম ফেলার ফুরসত নেই যেন কারোরই।পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলদস্যু সমস্যাসহ নানা কারণে বছরের বেশিরভাগ সময়ই জেলেদের নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে মাছ শিকার করতে হয়। তাই দিনে দিনে এসব জেলে শ্রমিক দারিদ্র্যের বেড়াজালে আটকে পড়ছে। সোহেল আরো জানান, এখানকার বেশিরভাগ শ্রমিকই প্রতিদিনের রোজগার দিয়ে তাদের সংসার পরিচালানা করেন। মাছ সরবরাহ ভালো থাকলে তাদের আয়ও ভালো হয়। বর্তমানে এখানে ইলিশের সরবরাহ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। এই সুযোগে হয়তো এখানকার জেলে শ্রমিকরা কিছুটা পিছুটান কাটিয়ে উঠতে পারবে।জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যানুযায়ী, জেলার ছয়টি উপজেলায় মোট ২৯ হাজার ৫৪১টি জেলে পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে সদরে সাত হাজার, আমতলী উপজেলায় সাত হাজার ২০০, পাথরঘাটায় নয় হাজার ৭১, বামনায় এক হাজার ১০০ ও বেতাগী এবং তালতলী উপজেলায় চার হাজার ১৭০টি জেলে পরিবারের বসবাস।তবে বেসরকারি হিসাবে বরগুনায় জেলেদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে জেলার পাথরঘাটা, আমতলী ও তালতলী এলাকা ভৌগোলিক কারণেই জেলে অধ্যুষিত। এসব এলাকায় অন্তত ৪০ হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। এসব জেলের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস বঙ্গোপসাগর ও স্থানীয় নদ-নদীতে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ শিকার। বরগুনার তালতলী উপজেলার তালতলী, বগী, পঁচাকোড়ালিয়া ও পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা, কাকচিড়া, কালমেঘা এবং সদর উপজেলার চালিতাতলী, পুরাকাটা ও নলী বাজার ঘুরে জানা গেছে, এসব এলাকায় ইলিশের বাজার আবারো জমজমাট হয়ে উঠেছে। জেলেদের জালেও ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অন্য সময়ের চেয়ে এখন বাজারে ইলিশের ব্যাপক সরবরাহ রয়েছে। ক্রেতাদের আনাগোনাও বেশ ভালো। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাক-ডাকে এখন মুখরিত এসব বাজার। একজন প্রান্তিক জেলে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার ইলিশ বিক্রি করছেন।তালতলী উপজেলার বগী বাজারের জেলে রাসেল (৩৫) জাগো নিউজকে জানান, নদীতে এখন প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। এভাবে ইলিশ ধরা পড়লে সংসারে আর কোনো অভাব-অনটন থাকবে না।এদিকে বরগুনা বাজারের ক্রেতা আব্বাস (৩০) জাগো নিউজকে জানান, বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে ইলিশে সরবরাহ বেশ ভালো। দাম কম থাকায় ইলিশের চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ। সাধ্যের মধ্যে ইলিশ থাকায় প্রত্যেকের খাবার মেন্যুতে প্রতিদিনই স্থান পাচ্ছে ইলিশ।বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জাগো নিউজকে জানান, উপকূলের সকল জেলে ও ট্রলার মালিকই ঋণে জর্জড়িত। আরো কিছুদিন এভাবে সাগরে মাছ পাওয়া গেলে তারা সবাই আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. ওয়াহেদুজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, গত বছর সকলের প্রচেষ্টায় অন্য বছরের চেয়ে বহুগুণে মা-ইলিশ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ফলে বর্তমানে নদী ও সাগরে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত আবারো প্রজনন মৌসুমে শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে সরকার। এসময় মা-ইলিম রক্ষার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।এদিকে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লে. কমান্ডার এম ইস্কান্দার আলী খান জাগো নিউজকে জানান, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে শুধু ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫৫ টন, যার মূল্য ছিল ৩৯ কোটি ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৪ টাকা। সরকার এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বিক্রীত মাছের ওপর শতকরা ১.২৫ টাকা রাজস্ব আদায় করে। সে হিসাবে গত ১৯ দিনে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র শুধু ইলিশ থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৬ হাজার ২০৫ টাকা।এফএ/এমএস

Advertisement