ধর্ম

মুসলমানদের শিক্ষায় হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অবদান

বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শুধু দানবীরই ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানুষের প্রতি মায়া-মমতার মূর্তপ্রতীক। মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে তিনি ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক সংস্থায় তাঁর সর্বস্ব দান করেছিলেন। দান ও মহানুভবতার জন্য তার অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের জীবন ও কর্ম সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-পরিচয়হাজি মুহাম্মদ মহসীন ১৭৩২ সালে পশ্চিম বঙ্গের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আগ মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল জয়নব। তাঁর পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল সুদূর পারস্যে। সেখান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে এসেছিলেন এদেশে। তারপর স্থায়ীভাবে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি শহরে আবাস গড়ে তুলে ছিলেন।মাতৃ পরিচয়হাজি মুহাম্মদ মহসিনের মায়ের নাম জয়নব খানম। তিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের খাজাঞ্চি আগা মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রী। ভাগ্যের অন্বেষণে ভারতবর্ষে আসা আগা মোতাহার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর ঘরে কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি জয়নব খানমকে সন্তান লাভের আশায় বিবাহ করেন। দীর্ঘ দিন পর মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিল এক কন্যা সন্তান। তাঁর নাম ছিল মন্নুজান। আগা মোতাহার একসময় তাঁর মেয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করেন। মন্নুজান ছোট থাকায় এ দানপত্র তিনি একটি মাদুলিতে ভরে তাঁর গলায় পরিয়ে দেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা দেখার জন্য উপদেশ দেন।আগা মোতাহারের মৃত্যুর পর মন্নুজান শবে মাত্র কৈশোরে পদার্পন করেছে। সে মাদুলি খুলে দেখেন আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পদ মেয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। যা দেখে জয়নব খান মন্নুজানকে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। তাই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আগ মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহকে। এ ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেন দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন। তখন সৎ বোন মন্নুজানের বয়স ১৩ বছর। মন্নুজানও ভাই পেয়ে মহা খুশী। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের লালন-পালন, দেখাশুনা ও বাল্য শিক্ষা মন্নুজানের তত্ত্বাবধানেই চলতে লাগলো।শিক্ষা গ্রহণস্থানীয় মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন হাজি মুহাম্মদ মহসিন। সেখানে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষা শিখতে লাগলেন। অল্প বয়সে তাঁর মেধা ও মনের গভীরতার পরিচয় পেয়ে শিক্ষকগণ অবাক হয়ে যান। চারিদিকে তার অসাধারণ মেধার কথা ছড়িয়ে পড়ে। পরে মুর্শিদাবাদের নবাব তাঁর মেধা কথা জানতে পেরে তাঁকে ডেকে পাঠান উচ্চ সরকারি পদ গ্রহণ করার জন্য। ইতোমধ্যে তাঁর পিতা মারা যান। মাতৃতুল্য বোনকে একা রেখে কোথাও আবদ্ধ থাকতে তিনি পছন্দ করলেন না।বোনের সম্পদ রক্ষাএদিকে মন্নুজান যৌবনে পদার্পন করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন শিক্ষাকালে মন্নুজান হুগলিতে একাকি বাড়িতে থাকতেন। একদিকে তাঁর অনেক সম্পদ অন্য দিকে যুবতী মেয়ে। তাই কিছু দুষ্ট লোক তাঁর পেছনে ষড়যন্ত্র করতে লাগলো। তাই মন্নুজান ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ভাই হাজি মুহাম্মদ মহসিনকে পত্র পাঠান। পত্র পেয়ে হাজি মুহাম্মদ মহসিন বোনকে রক্ষায় বাড়ি ফিরে আসেন। ভাই মহসিনকে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন।বোনের বিবাহবোনকে সুপাত্রস্থ করার জন্য মহসিন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে হুগলিতে নবাবের নিযুক্ত ফৌজদার সালাহউদ্দিনের সঙ্গে বোনের বিবাহ দিলেন। ধন-সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত হাজি মুহাম্মদ মহসিন বোনের বিয়েল পর দেশ ভ্রমণে বের হন। সফরকালে তিনি হজ পালন করেন। তিনি মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করেছেন। সফর শেষে দীর্ঘ ২৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর বিবাহ-শাদিতে মন বসছিল না। তাই তিনি সংসার জীবন থেকে দূরে ছিলেন।সম্পদের উত্তরাধিকার লাভবোনের অনুমতিক্রমে হাজি মুহাম্মদ মহসিন মুর্শিদাবাদে আসেন। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। এ দিকে নিঃসন্তান বোন মন্নুজান স্বামীকে হরিয়ে বিধবা। তিনিও বার্ধক্যে উপনীত। এদিকে বিশাল সম্পদের মালিক আবার একাকি নিঃসঙ্গ। বোন মন্নুজান সম্পদের পেরেশানি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ধ্যানে জীবন কাটাতে ছোট ভাইয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পদ লিখে দেন। সম্পদ লিখে দেয়া কয়েক বছর পর ১৮০৩ সালে বোন মন্নুজান ইন্তেকাল করেন।দানবীর মহসিনহাজি মুহাম্মদ মহসিন খুব ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন এবং সহজসরল জীবনযাপন করতেন। তিনি চিরকুমার ছিলেন। ৭০ বছরের হাজি মহসিন এ বিপুল সম্পদ দানসদকায় ব্যয় করার মনস্থ করলেন। এ বিশাল সম্পদ তিনি মানবজাতীর কাজে ব্যয় করেন। দেশের সকল গরীব-দুঃখী ও দুঃস্থদের সেবায় তিনি নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেন।মহসিন ফান্ড প্রতিষ্ঠাঅবশেষে তিনি মুসলমানদের সুশিক্ষায় ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সমুদয় অর্থ এ ফাউন্ডেশনের জন্য দান করেন। এ ফান্ডের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য দুই জন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন। শুধু মোতাওয়াল্লি নিয়োগই নয়, মহসিন ফান্ডের ব্যয় নির্বাহের জন্য দানকৃত সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করেন।তন্মধ্যে তিনভাগ সম্পদ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য। চারভাগ সম্পদ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে খরচ করার জন্য এবং দুইভাগ সম্পদ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করেন। তাছাড়া তাঁর দানকৃত অর্থে অসংখ্য দারিদ্র্য ছাত্রের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়।ইন্তেকালআজ থেকে ২০০ বছর পূর্বে ধন-সম্পদের প্রতি নির্লোভ বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালে ৭৯ মতান্তরে ৮০ বছর বয়সে হুগলির নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।পরিশেষে...এ মহান দানবীর তাঁর অসামান্য দানের কারণে কিংবদন্তীতে পরিণত হন। তাঁর স্মরণে হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি কলেজ। বাংলাদেশের ‘চট্টগ্রাম সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা হয় তাঁর ওয়াকফকৃত অর্থ থেকে প্রাপ্ত অনুদানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মহসিন হল’ এবং ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি ‘বিএনএস হাজি মহসিন’ও তাঁর স্মরণে নামকরণ করা হয়।আল্লাহ তাআলা বাংলার শ্রেষ্ঠ মুসলিম দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের সকল দানকে কবুল করুন। তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর দানের অনুপ্রেরণা আমাদেরকে দান করুন। আমিন।এমএমএস/পিআর

Advertisement