সাহিত্য

অথবা এটি কোনো গল্প নয়

অক্ষর এবং বর্ণ দু’জনই অনেক ক্লান্ত। এগিয়ে যাচ্ছে সময় বৃষ্টির গতিতে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছিলো প্রত্যাশা। দু’জনেরই রাক্ষুসে খুদা প্রবণ হয়ে উঠেছে। বর্ণ যতটুকু চমক নিয়ে আসে অক্ষরের কাছে অথবা অক্ষর যতটুকু অনুভূতি নিয়ে আসে বর্ণের সামনে। তা পর্যাপ্ত নয়। অভাব লেগেই থাকে তাদের সংসারে। ভালোবাসার অভাব। তারা দিনকে দিন উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত তারপরে একদিন নিম্নবিত্ত হয়ে ওঠে। ভালোবাসার অনটনে অশান্তির চরমে উঠেছে তাদের ঘর-সংসার।আর যথারীতি নিম্নবিত্ত মানে-ই তার কোনো গোপন কথা থাকবে না। সমাজের সবাই জেনে যাবে তার ঘরের খবর। কারণ নিম্নবিত্তদের বাসার দেয়ালগুলো খুবই পাতলা থাকে একদমই সাউন্ডপ্রুভ না। আর তাই তাদের মধ্যকার অভাববোধ ছড়িয়ে গেলো চারপাশের মানুষজনের কাছে।দু’জনের আশে-পাশের মানুষ বুঝে গেলো অক্ষর এবং বর্ণ দু’জনই এখন দারিদ্র সীমার নিচে। সুযোগটা কাজে লাগাতে জড় হলো অনেক মানুষ। কখনো রাজনৈতিক লোক আবার কখনো সমাজসেবক আবার কখনো এনজিও অথবা কখনো হৃদয়বান ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো এবং উপায় বলে দিলো অবস্থার উন্নতি করার ব্যাপারে। তাদের দরিদ্রতার গল্প উদাহরণ হলো জীবনবোধের।কেউ একজন হয়তো নিয়ে এসেছিলো একটা বই; ধনী হওয়ার সহজ উপায়। অথবা ৩১ দিনে ধনী হওয়ার উপায় অথবা ধনী হওয়ার ১০১টা উপায়। এইসব বই এবং সব ধরনের উপদেশ অক্ষর ও বর্ণ নিতে শুরু করলো। তারা ধীরে ধীরে দরিদ্রতা থেকে রূপান্তর হয়ে জ্ঞানী হতে থাকলো। তারা এখন খুব ভালো করে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছে ভালোবাসা কাকে বলে?কিন্তু সেই ভালোবাসার সংজ্ঞা হয়ে গেলো দু’টি। একটি অক্ষরের মাথায় অন্যটা বর্ণের মগজে। এই জ্ঞান তাদের আরো দরিদ্র করে দিলো। আগে তবু এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি ভালোবাসা ছিলো; তাও এখন উধাও।অক্ষরের একজন ব্যক্তিগত বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অর্থির আগমন। ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের মতো সারাক্ষণ অচেনা সব শব্দ আর ভাবার্থমূলক বাক্য দিয়ে কিম্ভুতকিমাকার করে রাখলো অক্ষরের আপাদমস্তক।অক্ষর কলেজ থেকে এখন অর্থির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। সেখানে পেছনে একটা দরজা আছে যেখান দিয়ে চাইলে ক্লাসের থেকে বের হওয়া যায়। যেটা তার কলেজে ছিলো না। এই স্বাধীনতাটুকু অক্ষর পেয়ে ভীষণ খুশি হলো। সে ভাবতে শুরু করলো এই তো আসলে প্রকৃত জায়গা। যেখানে স্বাধীনতা আছে। মধ্যবিত্তের কাছে স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার আর উচ্চবিত্তের কাছে স্বাধীনতা মানে সব ধরনের অনিয়ম করার সুযোগ করে দেয়া।অক্ষরের তখন মনে পড়তে শুরু করলো কলেজের কথা। বর্ণ তাকে কী রকম যন্ত্রণা দিতো। কোনো স্বাধীনতা ছিলো না তার। এটা-ওটা-সেটা, এগুলো-ওগুলো-সেগুলো একদম-ই করা যাবে না।‘করা যাবে না’ কথাটা খুবই যন্ত্রণার হয়ে উঠেছিলো অক্ষরের কাছে। তখনই মাথার ভেতরে ‘করতে হবে’ কথাটা ঢুকে গিয়েছিলো। কারণ মানুষের মস্তিষ্কে নিষেধগুলোর উপরে বেশি পরিমাণে লোভ জন্মায়।সে অর্থির বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস করতে শুরু করলো। একদিন হুট করে ক্যান্টিনে চলে আসলো অর্থি আর অক্ষর। বেশিদিন না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অর্থাৎ ফুচকা খাওয়া-শপিংয়ে যাওয়া আরো বিভিন্ন কাজ যৌথভাবে করতে শুরু করলো। তাদের মধ্যে যুথবদ্ধতা বাড়তে শুরু করলো।আস্তে আস্তে অক্ষর আবারও ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। স্বপ্ন নয়- একদিন অর্থিকে কষিয়ে একটা চুমু খেয়ে ফেললো অক্ষর। সেই চুমুর খত চিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন অর্থি। তার ভেতরে এক ধরনের চাপা স্বভাব যেহেতু রয়েছে। তাই সবকিছু ছাপিয়ে তারা শুরু করলো আরেকটা গল্প। সেই গল্পটা আসলে ছোটগল্পের মতো। উপন্যাস হয়ে উঠছে না কিছুতেই। মনে মনে ভীষণ চাচ্ছে অর্থি- গল্পটাকে উপন্যাস করে তুলবে।অক্ষর ভাবছে অন্যকিছু। তবে এই অন্যকিছুটা খুবই আবছা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। এমনকি অক্ষর নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, একবার বর্ণের কাছে ফিরে যাই। আবার মনে হয় অর্থির কাছাকাছিই থাকি।যেহেতু অর্থির কাছে সবকিছু বলে দেয়া যায়। স্বাধীনতাটুকু আছে, তাই অর্থির মুখোমুখি হলো অক্ষর। বলে দিলো তার পিছনে ফিরতে ইচ্ছে করছে। অর্থি ভীষণভাবে চাচ্ছিলো অক্ষর শুধু তারই হোক কিন্তু সমস্যা হলো গল্পকারের। কারণ গল্পকার অর্থির চরিত্রকে একটু চাপা স্বভাবের রেখেছে। যেখান থেকে বেরিয়ে এসে মুখ ফুটে অর্থি কিছু বলতে পারছে না। অক্ষর সিদ্ধান্তহীনতায়। অর্থি মুখোশ পরে বসে আছে। কিন্তু বর্ণ কি করছে? বর্ণ যেহেতু বোকা স্বভাবের সে অপেক্ষা করছে। কোনো একদিন অক্ষর তার নিজস্ব স্বরলিপিতে লিখবে মহাকাব্য।কিন্তু বর্ণ কতদিন অপেক্ষা করবে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে বর্ণ প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে কোনো একজন পুরুষের কাছে নিজের অপেক্ষার কষ্টের কথা বলে যাচ্ছে। ওই পুরুষ খুব ব্যস্ত। তারা শুনে যাচ্ছে আর একটু একটু উত্তর দিচ্ছে। ওই পুরুষ যোগাযোগটাও রাখছে বর্ণের সাথে। কারণ বর্ণ সুন্দরী বোকা স্বভাবের মেয়ে। মোটামুটি অনেক পুরুষ মানুষই বোকা স্বভাবের মেয়েদের পছন্দ করে। সারাক্ষণ পুরুষরা বলবে, ‘এটা আসলে এই রকম। এইটা আসলে ওই রকম।’ সব জ্ঞান বিতরণ করবে কিন্তু কোথাও একটা জায়গায় মূর্খ করে রাখবে তার বোকা সঙ্গীকে।বর্ণ হয়তো কোন একজন চালাক পুরুষের সাথে কফি খেতে বের হবে অথবা লং ড্রাইবে যাবে। চালাক পুরুষটিকে হয়তো বর্ণ চুমু খেয়ে ফেলবে। আর বর্ণের চোখ দিয়ে হয়তো পড়তে থাকবে জল। পুরুষটি ভাববে মেয়েটি মনে হয় এতো তাড়াতাড়ি নিতে পারেনি ব্যাপারটা। কিন্তু সব গল্পে, সব চরিত্রের চোখের পানির মানে এক রকম হয় না। এইখানে বর্ণ ভাববে অথবা ভাবতে হবে অন্যকিছু। বর্ণের চোখের জল অক্ষরের পথকে কি কোনোভাবে কাদায় ভরে তুলবে কি না এটাও এখন বলা যাচ্ছে না।অক্ষর জানে না সে বর্ণের কাছে ফিরবে নাকি অর্থির কাছে থাকবে। অর্থি মুখোশ পরে বসে আছে। বর্ণ হয়তো ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দিচ্ছে। কখনো গানের লিংক আবার কখনো কোন ভালো উক্তি। এসব দেখে হয়তো কেউ কেউ বর্ণকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। তোমার কি মন খারাপ?কাউকে কাউকে উত্তর দিচ্ছে বর্ণ আবার কাউকে কাউকে দিচ্ছে না। অর্থি খুব একটা যোগাযোগ করছে না অক্ষরের সাথে। কারণ অর্থি নিজেকে একটু আড়ালে রাখতে চায়। সবকিছু জোড় করে পাওয়ার চেষ্টা সে কখনো করে না। অক্ষর আজকাল অর্থির কাছ থেকে তেমন কোনো জ্ঞান পায় না। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে জ্ঞানশূন্য হয়ে উঠছে। অক্ষর মাঝে মাঝে অর্থির উপরে বিরক্ত হয়। সে প্রচণ্ড ক্ষেপেও যায়। অদ্ভুত বোকার মতো নিজেকে প্রশ্ন করে- তাহলে অর্থি কি আমাকে ভালোবাসে না? খুব রেগে গিয়ে সে আসলে কি করে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে কি কখনো এটা ভাবে- আমিই তো অন্যায় করছি অর্থির সাথে। হয়তো ভাবে অথবা না।আবার বর্ণের কাছে যখন অক্ষর যায় তখন বর্ণ অন্যদিকে তাকিয়ে তাকে। বোকা বোকা প্রশ্ন করে। পিছনের বিভিন্ন স্মৃতি মনে করিয়ে বিরক্ত করে অক্ষরকে। তখন অনেক রেগে ক্লান্ত হয়ে অক্ষর অর্থির কাছ থেকে চলে আসে। কিন্তু চলে আসার পরে সম্ভবত অক্ষর হাঁটে আর চিন্তা করে- আমি চলে আসলাম কেন? গল্পগুলো তো সত্যিই। এই গল্পে তো আমি অভিনয় করেছি। আমারই কেন ভালো লাগছে না গল্পটা। অক্ষর পকেট থেকে ফোন বের করে বর্ণকে কল দেয় কিন্তু বর্ণ তখন আবার ফোন ধরে না।বর্ণ তখন বসে বসে চোখের জল দিয়ে কাজল ভিজিয়ে দেয়। চোখের জলে ভেজা কাজলে বর্ণকে দেখতে দারুণ লাগে। অনেক মায়াময় হয়ে ওঠে বর্ণ। কিন্তু অক্ষর হয়তো ওইচোখ দেখেনি অথবা দেখেছে।তারচেয়েও তীব্র আকুতি অর্থির চুপ করে থাকা এবং সব কিছু খুব সহজে মেনে নেয়া। খুব সহজেই বলে দেয়া, তুমি তোমার মতো করে গুছিয়ে নাও তোমার জীবন। আমি তোমার কোনো কিছুতে বাঁধা হবো না।অক্ষর তখন কি বলে আমি ঠিক জানি না। অর্থি নিশ্চয়ই জানে। কিন্তু অর্থির আবার ভুলোমন। পাশাপাশি অর্থি সবকিছু লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। এই ব্যক্তিগত কথাটা অর্থি পাঠকের সাথে শেয়ার করতে চাচ্ছে না।অক্ষরের অনেক অসুবিধা। এতো অসুবিধার মধ্যে একটাই সুবিধা। তাহলো অক্ষর ধূমপায়ী। যদিও অক্ষর কখনোই নিঃসঙ্গ থাকে না। কারণ ধূমপান নাকি নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। তারপরেও অক্ষরের ভেতরে থাকা সমস্ত খারাপ লাগাগুলো সে পুড়িয়ে বাতাসের সাথে উড়িয়ে দেয়। দূষিত হতে থাকে শহরের বাতাস। তাতে অক্ষরের কিছু আসে যায় না। এমনকি নিজের ভেতরের আবহাওয়াটাকেও নষ্ট করে দেয় অক্ষর।অক্ষর কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়েই অনেক দিন পার করে দিতে পারে। বর্ণও তাই পারে- এমনকি অর্থিও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই অনেক দিন থাকতে পারবে। তবে তাদের একটা সিদ্ধান্তের দরকার।কারণ বর্ণকেও অনেক সুন্দর সুন্দর প্রোফাইল পিকচারের ছেলেরা বিভিন্ন সময়ে কফির দাওয়াত দেয়। পাশাপাশি অর্থিও বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন ইনভাইটেশন পায়। অন্যদিকে অক্ষরও মাঝে মাঝে কোনো কোনো মেয়ের প্রোফাইল দেখে তাকে নক করলে একটু আকটু কথা বাড়াতে বাড়াতে কফি পর্যন্ত চলে যায়।তার মানে দাড়ালো- বর্ণ, অর্থি এবং অক্ষর প্রত্যেকেই ব্যস্ত। ভীষণ রকম ব্যস্ত। কিন্তু এই ব্যস্ততার মধ্যে মাঝে-মাঝে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তারা একটু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। যখন বর্ণ কোনো ছেলের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যায়, এটা অক্ষর দেখলে ক্ষেপে যায়। আবার একইভাবে যখন অর্থি কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে যায়; তখন অক্ষরের মাথায় আগুন ধরে যায়।অন্যদিকে বর্ণ এবং অর্থি যদি অক্ষরকে তাদের দু’জন ছাড়া অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে দেখে; তখন আবার দু’জনই ক্ষেপে ওঠে। তারা তিনজনই হয়তো চুটিয়ে অন্য কারো সঙ্গে গল্প করছে- আড্ডা মারছে।কিন্তু প্রত্যেকই প্রত্যেকের ওই মুহূর্তগুলো সহ্য করতে পারে না। এটা সমাধান হওয়ার যোগ্য কিছু নয়। তবে অমিমাংসিত এই মুহূর্তগুলো অতটা খারাপও কিন্তু না। আবার খুব যে একটা ভালো তাও বলছি না। আমি আসলে কি বলছি এটাও মনে হয় পরিষ্কার না। তবে পরিষ্কার বলে কিছু নেই।সবাই ভালোবাসার শুরুর দিকে অনেক উদার-মহৎ থাকে। কিন্তু দিন যেতে থাকে আর তারা প্রত্যেকেই অনেক বেশি সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একদিন শেভ না করলে যেমন গালের মধ্যে চুল গজায় তেমনি একদিন প্রেমের মেয়াদ বাড়লে মনের মধ্যে ঘুণ জন্মায়।যে যেখানে জন্মাচ্ছে তাদেরকে সেখানে জন্মাতে দেয়াই যদি আনন্দদায়ক হয়। তবে তা-ই করা উচিত। মোটকথা জীবনের যতটুকু সময় আনন্দ উৎপাদনের পিছনে ব্যয় হয়, ওটাই উৎকৃষ্ট সময়।এসইউ/আরআইপি

Advertisement