মতামত

কেউ কথা শোনেনি, পঁয়তাল্লিশ বছর কেটে গেল

কয়েকটা দিন সকালগুলি খুব সুন্দর হচ্ছে। দিন শুরু হয় যে পত্রিকার পাতা খুলে, সেই পাতায় পর পর কিছু দিন খুব আশাব্যঞ্জক খবর এসেছে। চিহ্নিত জঙ্গি ধরা পড়ছে, রিশার খুনি ধরা পড়ছে, যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে। পক্ষ বিপক্ষে তর্কের ঝড়ও উঠছে। সামাজিক মাধ্যমে কোনোদিন আমি চ্যাঁচাচ্ছি, কোনোদিন আমার কোনো বন্ধু, লেখক, সাংবাদিক, এক্টিভিস্ট সোচ্চার হচ্ছেন। আরও সাহ্সী যারা তারা রাজপথেই নেমে পড়ছেন। তর্ক-বিতর্কের সারাংশ-সারমর্ম তুলে ধরতে ধারাবাহিকভাবে অপরাধের জন্মকাল ধরে সর্বশেষ থেকে সর্বপ্রথমে যাব।   ১। জঙ্গিবাদ দমন : তর্ক :  এরা কি সত্যিই “তারা”? ধরার পড়ে তথ্য বের করার আগে-পরে ক্রসফায়ার হচ্ছে কেন? ওমুক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী, শিক্ষকের নাম আসছে তো তদন্তের তাগিদটা ব্লগার রাজীব হত্যায় খেয়াল হয়নি কেন? আর হলেই বা কি, সরকারি দলের এমপির ছেলেও তো আছে, তার মানে সরকারের সংশ্লিষ্টরাই এতে জড়িত?   বিতর্ক :  আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর জনগণ আস্থা, বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে এ আজ করুণ সত্য। কিন্তু কাজ যে হচ্ছে- ধরা পড়ছে তারা যে জঙ্গি তা তাদের প্রাপ্ত প্রমাণাদি, অস্ত্রশস্ত্র, অবস্থান, যাপিত জীবনই প্রমাণ। হতবাক হয়ে যাই যখন বিএনপি থেকেও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যখন তাঁদের সময়কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলাসহ কয়েকবার হ্ত্যা প্রচেষ্টার মত সন্ত্রাস হয়েছে এবং তার সুরাহার কোনো চেষ্টাই তারা করেনি। এবং পরবর্তীতে প্রমাণিত যে তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছিল! বিচারবহির্ভূত হত্যায় কোনো সমর্থন থাকতে পারে না। কিন্তু কারণ হিসেবে “আমার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা” এই,  বিচ্ছিন্ন এসব ফিসপ্লেট বা স্লিপিং সেলের কাছে গোটা সংগঠনের কোনো তথ্যই থাকে না। তাদের একেকটা হামলার আগে নিয়মিত কর্মী কাউকে দিয়ে টার্গেট করে বেছে নিয়ে অল্প কিছুদিনের ট্রেনিংয়েই অপারেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়;  যার ফলে তারা না দিতে পারে কোনো তথ্য আবার এদের ছেড়ে দেয়াও সঙ্গত কারণেই অসম্ভব। উল্লেখিত ইউনিভার্সিটি ছাড়াও একের পর এক টার্গেট হত্যা আমলে আনায় বিলম্বের আর ভয়াবহ গাফিলতির মাশুল গুলশানের এতো বড় জঙ্গি হামলা যা সারা বিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে, প্রবাসী বাঙালিদের জীবন সঙ্কটাপন্ন করেছে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে বৈদেশিক সম্পর্ককে যার ভিত্তিতে আমাদের প্রচুর অনুদান প্রকল্প, ব্যবসায়িক সম্পর্ক হুমকির ভেতর পড়ে গেছে।   আমাদের মতো সেক্যুলার দেশে কোনোদিন জঙ্গিবাদ হানা দেবে না বলে যে বিশ্বাস ছিল, যেই বিশ্বাসে কঠিন আঘাত এসেছে; কিন্তু তা নির্মূলের পদক্ষেপ কিছু দেরিতে হলেও যে নেয়া হচ্ছে- সাধুবাদ এজন্যই। একের পর এক টার্গেট খুনেও প্রশাসনে যেন বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, সেই আশঙ্কা দূর হবার আশা দেখছি। আরো জোরদার হোক, কিছু অপচয় কিছু বলিদান হবে এই সোপান তলে, এটাই রীতি। তবুও আমরা বাংলার আকাশে আবার চীল, শকূনদের দেখতে চাই না।   ২। নারী ও শিশু হত্যাকাণ্ড :  তর্ক : এবারের তর্ক আমি নিজেই তুলেছিলাম। রিশা হ্ত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষদর্শী ছিল বলে দ্রুত ধরা পড়েছে। সত্য বচন। কিন্তু আফসানা হত্যাকাণ্ডে কি সিসি ক্যামেরায় আলোচিত ছাত্রলীগ কর্মীসহ যে দুজন তার নিথর দেহ হাসপাতালে ফেলে গিয়েছিল তাদের চেহারা অস্পষ্ট হলেও নেই? এসব অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তার পুনরাবৃত্তি ঘ্টবেই। উদাহরণ, ইদানীং গ্যারেজের টায়ার পাম্প দিয়ে বাতাস পেটে ঢুকিয়ে হত্যাপ্রচেষ্টা কতোগুলি নজরে আসছে! আর অন্যদিকে এসিড সন্ত্রাস মহামারী কীভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে দমন হয়েছে। তনু হত্যাকাণ্ড আজ বিচার না হলে কালে বিএনপি আমলের ইয়াসমিন হ্ত্যার মত সাক্ষী দেবে। কত বড় মহারথী এতে জড়িত যে আইনের লম্বা হাত তাকে ছুঁতে এতো কম পড়ে যায়? যতজন বিকারগ্রস্থ পিশাচকে এই বিচারহীনতা একই অপরাধে উদ্বুদ্ধ করবে আর জনতা য্তখানি বীতশ্রদ্ধ হবে তার চেয়েও মূল্যবান সেই অপরাধী? ত্বকীর খুনির নাম সারা দেশবাসী জানেন, তবুও যেদিন দেশপ্রধান নিজেই ওসমান পরিবারকে চির অব্যাহতির কথা বলেন কলিজায় দগদগে ক্ষত হয়ে যায়। জাতীয় বিবেক বোকা হয়ে যায়। নিজেদের অভিভাবকহীন মনে হয়।   ৩। যুদ্ধাপরাধী:  তর্ক: এই বিষয়ে সাধুবাদ ছাড়া কোনো তর্ক উঠতেই পারে না। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছর পর জাতি কলংকমুক্ত হতে শুরু করেছে। কতলক্ষ স্বজন হারা পরিবার যুদ্ধে তাদের বুকের মানিক সাদকা দিয়েও আজ ৪৫ বছর ধরে জীবন যুদ্ধ করে চলেছেন। তাদের এই অমানবিক আত্মত্যাগের সান্ত্বনা জানানোর ধৃষ্টতা নাই, তাদের প্রতিটি আহাজারির কাছে, প্রতি বিন্দু চোখের জলের কাছে আমরা প্রত্যেকে ঋণী এবং এই ঋণমুক্তির ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা এতোদিনে করতে পারছি। নাহলে অনেকের মতন বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছিলাম যুদ্ধাপরাধী বিচারের এই ট্রাম্প কার্ড আজীবন নির্বাচনী ইস্তেহারেই ব্যবহৃত হবে।  তবুও তর্ক উঠছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দেয়া তথ্যের পরে যাচাই বাছাই সাক্ষী সাবুদ উপাত্ত এতো অপর্যাপ্ত কেন এবং উপস্থাপনে এতো জোড়াতালি কেন?  হিটলারের গ্যাস চেম্বারে ইহুদী নিধনের তালিকা তারা নিজেরাই নিখুঁত নথিভুক্ত করেছিল তাদের শৌর্য্য বীর্জের ইতিহাস হিসাবে যা তাদের আকস্মিক পরাজয়ে বুমেরাং হয়ে গেছে। অন্যথায় ৪০ বছর পর এমন নথি দুষ্প্রাপ্য। তবুও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে তৎপরতা আজ এই মহান বিচার কার্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো না। আর প্রধানতম তর্ক; সরকারের ভেতরে গদিনসীন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে নিরপেক্ষতার প্রমাণ কই? বিতর্ক :  দাবি অযৌক্তিক নয়। এখানে বিতর্ক হচ্ছে সরকারি দলের যুদ্ধাপরাধী কারো কি এই মাপের অপরাধ ছিল যে নিজামী, গোলাম আজম, সাঈদীর সমকক্ষ ছিলেন? তবুও, আমরা চাই জাতির কলংকমোচনে এই পবিত্র দায়িত্বে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা আসুক। কেউই দেশের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু, যুদ্ধের বিরোধী পক্ষ যেখানে এসে বার বার যুক্তিতর্ককে কুতর্কে প্রমাণ করছেন সেক্ষেত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লাইন পাল্টে বলতে হয় “কেউ কথা শোনেনি, পঁয়তাল্লিশ বছর কেটে গেল...”! কারণ; এই বিচারে যুদ্ধের সময়ের ভূমিকাই প্রাধান্য, এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য যুদ্ধের পরবর্তী স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা, অস্বীকার, অপরাধীদের নিজেদের ভূমিকার জন্য কোনো রকম ক্ষমা স্বীকার না করে উপরন্তু দাম্ভিকতা প্রকাশ করে তাদের কৃতকর্মকে যুক্তিযুক্ত করা। এই বিচার মহান মুক্তিযুদ্ধের অবমাননাকারীদের স্বাধীন বাংলায় একটি প্রতিকী বিচার।  নিরপেক্ষতার প্রশ্নে সরকারি দলভুক্তদের নাম বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও অপরাধের দাঁড়িপাল্লায় তাদের নাম আসতে বহু লম্বা তালিকা পার করতে হবে। রাজাকার, আলবদর বাহিনীতে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত নাম হাজার লাখে ছিল। আজ তাদের প্রত্যেকের এমন বিচার কাজে তাদের ভুক্তভোগীদের পরিবারকেও এগিয়ে আসতে হবে। "সে করে বিস্তর ভুল, যে করে বিস্তর।” যে কাজ করেনা তার ভুলেরও আশঙ্কা নাই। জনগণ কেন কোনো আমলে কি হয় নাই, কেন  হাল আমলের আধ-পূর্ণ গ্লাস না দেখে আধ-খালিটাই  দেখে বেড়ায় তার জবাব একটাই, মানুষ যে করে তার কাছেই আশা করে। আপন মানুষের ওপরই মানুষের দাবি থাকে, অভিমান হয় এবং আমরা মনে করতে চাই আমাদের সরকার আমাদের ধারণ করেন, আমাদের প্রয়োজনীয়তা, কষ্ট অনুধাবন করেন। তাই, আজকের দিনে সাফল্যের ধারাবাহিকতার সবচেয়ে বড় দাবি সুন্দরবন। বিদ্যুৎ চাই, কিন্তু কেন এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রস্তাবিত ভূ-খণ্ডে সরে যেতে পারে না?মাননীয় সরকার প্রধান, আপনি এ ধরনের দাবি আগেও মেনেছেন। জানি আমরা বাঙালি সব নতুন কিছুইতেই “মানিনা” বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু সুন্দরবন রক্ষার দাবি সেই অযৌক্তিক জায়গায় আটকে নেই। এখানে যদি প্রতিবেশির সঙ্গে সম্পর্কটাকেই বড় করে দেখা হয় এই সম্পর্কের শুরু যেই মানুষটার হাত ধরে, তিনি ৯ মাস ফাঁসির মঞ্চ থেকে সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে ভারতে তাঁর বন্ধুকে প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন “আপনার সেনাবাহিনী কবে সরাবেন?”। উষর ভূখণ্ডেও তিনি ভীনদেশের চলচ্চিত্রের আনয়ন বন্ধ করেছিলেন দেশের সিনেমাকে সমৃদ্ধ করতে। সেদিনও তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে মার্কিন সাংবাদিকদের সুচতুর ঝানু প্রশ্নবান বুমেরাং হয়ে ফিরে গেছে। তিনি আমাদের জাতির পিতা। আশঙ্কা, আপনার এই অসম বন্ধুত্ব আপনার বাবার দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্বের মহিমাকে ক্ষুন্ন করতে পারে, তাঁর স্বপ্নে- আদর্শে জন্ম নেয়া সোনার বাংলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।  আমরা পুরো জাতি সেই পিতার কন্যার দ্বারস্থ হলাম। প্রত্যাশায় থাকলাম সুন্দর আগামীর।  লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপানneeta2806@yahoo.comএইচআর/এমএস

Advertisement