পুরো ঘটনায় এত নাটকীয়তা, এত বাঁক, এত টুইস্ট- লিখলে বেস্ট সেলার রহস্য উপন্যাস হবে। কিন্তু এখনও উপন্যাস হয়ে উঠতে পারেনি তা, রয়ে গেছে ছোট গল্প, রহস্য গল্প। ছোট গল্পের সংজ্ঞা শিখেছি `শেষ হইয়াও হইলো না শেষ`। মিতু হত্যা এবং তার স্বামীর চাকরিচ্যুতির পর গল্প শেষ হয়নি, বলা যায় শুরু হয়েছে।বাবুল আক্তারকে আমি চিনতাম না। গত ৫ জুন চট্টগ্রামে তার স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তার নামও শুনিনি। স্ত্রী খুন হওয়ার দুদিন আগ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। তবে স্ত্রী খুনের সময় তিনি পুলিশ সুপার হিসেবে ঢাকায় সদর দপ্তরে সংযুক্ত ছিলেন। প্রকাশ দিবালোকে একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী খুন হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তখনই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বাবুল আক্তারকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। বন্ধুদের কাছ থেকেও বাবুল আক্তারের অনেক গল্প শুনি। সবই নায়কের গল্প। জঙ্গীবাদ বিরোধী নানা অভিযানে তার নেতৃত্বের গল্প তো আছেই, শুনেছি তার ব্যক্তিগত সাহসিকতার অনেক গল্পও। অনেকবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন তিনি। এসব সাহসিকতার অনেক স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। শুনে শুনে এমন একজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা আছেন জেনে আমরা গর্বিত হই, আমরা নিশ্চিন্ত হই।প্রথমে সবার সন্দেহ ছিল জঙ্গীদের দিকে। কিন্তু তদন্তের নানা পর্যায়ে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। এখন পর্যন্ত পুলিশ এ হত্যায় ১২ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে। তাদের মধ্যে ৮ জন কারাগারে। দুজনকে পুলিশ ক্রসফায়ারের নামে মেরে ফেলেছে। আর মুছা ও কালু নামে দুজন পলাতক। বলা হচ্ছে, মুছা শিকদারই এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। মুছা পলাতক বলা হলেও তার স্ত্রী পান্না আক্তার দাবি করেন, ২২ জুন চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে পুলিশ মুছাকে তুলে নিয়ে গেছে। তিনি যে পুলিশ মুছাকে তুলে নিয়ে গেছে, তার নামসহ উল্লেখ করেন। কিন্তু পুলিশ তা কখনোই স্বীকার করেনি। এই মুছাতেই এসে আটকে গেছে মিতু হত্যা মামলার সব রহস্য।মুছাকে তুলে নিয়ে যাওয়া বা তার হারিয়ে যাওয়ার দুদিন পর ২৪ জুন বাবুল আক্তারকে তুলে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে আবার ফিরিয়ে দেয়। এই ১৫ ঘণ্টাতেই ঘনীভূত সকল রহস্য। তারপর থেকেই গুজব-গুঞ্জনের ডালপালা মেলতে থাকে। সেই গুজবে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানা গল্প। সবচেয়ে চালু গল্পটি হলো এমন, মুছা শিকদার ছিল বাবুল আক্তারের সোর্স। বাবুল আক্তার ঢাকায় এসে তার সোর্স মুছা শিকদারকে দিয়ে তার স্ত্রীকে খুন করান। গোয়েন্দা কার্যালয়ে পুলিশ বাবুল আক্তারের সামনে দুটি অপশন দেন- হয় জেলে যেতে হবে, নয় চাকরি ছাড়তে হবে। বাবুল আক্তার নাকি দ্বিতীয় অপশনে বেছে নেন এবং পদত্যাগপত্রে সই করে বাসায় ফেরেন। এই গল্পটি পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ স্ত্রী খুন হওয়ার পর বাবুলের পাগলের মত চট্টগ্রামে ছুটে যাওয়া, কান্নায় ভেঙ্গে পড়া, ঘটনার পর থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে নিভৃত জীবনযাপন, মিতু খুন হওয়ার আগে তাদের সুখী জীবনের গল্প, ফেসবুকে স্ত্রীর প্রতি গভীর মমতামাখা স্ট্যাটাস, বরাবর বাবুলের পক্ষে তার শ্বশুরের সাফাই- সব মিলিয়ে বাবুলের প্রতিই ছিল সবার সহানুভূতি। কিন্তু বাবুল আক্তারের পদত্যাগপত্রের সূত্র ধরেই তার চাকরি গেছে। আমরা জানি না, ২৪ জুন কোন পরিস্থিতিতে বাবুল আক্তার পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। বাবুলের শ্বশুরের দাবি, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি, তাকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। পরে কাজে যোগ দিতেক চাইলেও তাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি। তিনি লিখিতভাবে আগে করা পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে চেয়েছিলেন, সে সুযোগও পাননি। শেষ পর্যন্ত ২৪ জুনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয় ৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সারাদেশের সহানুভূতি যার দিকে, যিনি নিজেও একজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা; তাকে কোন সূত্রে চাপ দিয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হলো? একজন পুলিশ কর্মকর্তারই যদি এই দশা হয়, তাহলে সাধারন মানুষ পুলিশের চাপের কাছে কতটা অসহায় থাকে? রহস্য ঘনীভূত হয় এ ব্যাপারে সবাই স্পিকটি নট হওয়ায়। বাবুল আক্তারের পদত্যাগের বিষয়ে কেউ ঝেড়ে কাশেননি। না পুলিশ, না বাবুল। বাবুল আক্তারের পদত্যাগ রহস্য উন্মোচিত না হলে জানা যাবে না মিতু হত্যা রহস্যও। মুছা শিকদারের খোঁজ না মিললেও আড়ালেই থেকে যাবে অনেক কিছু। কোন পুলিশ মুছাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?বলা হচ্ছে, বাবুল আক্তার দায়িত্ব পালনের সময় জঙ্গী, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করেছেন। কাউকে ছাড় দেননি। এখন সুযোগ পেয়ে বিভিন্ন সময়ে বাবুল আক্তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তরা জোট বেধে বাবুল আক্তারকে ফাঁদে ফেলেছেন। কিন্তু বাবুল আক্তার যদি নিজের অবস্থানে শক্ত থাকেন, তাহলে তিনি পুরো ঘটনা বলছেন না কেন? কারা তাকে চাপ দিয়েছে, কারা তাকে ফাঁদে ফেলছে; তাদের নাম বলছেন না কেন? পাল্টা আক্রমণে গেলেই তো উল্টো ফাঁদে পড়ে যাবে তার শত্রুপক্ষ। স্ত্রীকে যদি সত্যিই তিনি ভালোবাসেন, তাহলে তার খুনীদের ধরিয়ে দিতে, বিচারের আওতায় আনতে তার অবশ্যই মুখ খোলা উচিত।বাবুল আক্তার তার স্ত্রী হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত, এটা আর কেউ করলেও আমি বিশ্বাস করি না। যদি এমনটি হতোই, তাহলে আর যেই হোক, মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন, যিনি নিজেও একজন সাবেক পুলিশ কর্তা, তিনি অন্তত নিজের মেয়ের খুনীকে দিনের পর দিন আশ্রয় দিতেন না।পুলিশ কর্তারা আড়ালে-আবডালে বলছেন, পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ভাড়াটে খুনী দিয়ে স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন, এটা একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক নয়। তাই বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই বাবুলকে পদত্যাগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশের ভাবমূর্তি কি রক্ষা পেলো? স্ত্রী হত্যার পর যেমন, পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার পরও সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষের সহানুভূতি কিন্তু বাবুল আক্তারের দিকেই। সবাই সমানে পুলিশের অমানবিকতা আর নিষ্ঠুরতার সমালোচনা করছে।বাবুল আক্তার ইস্যুতে অবশ্যই পুলিশের অবস্থান পরিস্কার করা দরকার। যদি তিনি সত্যি সত্যি মিতু হত্যার সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে তার জায়গা হবে লাল দালান, শ্বশুর বাড়ি নয়। আর যদি তা না হয়, তাহলে তিনি সসম্মানে, দেশবাসীর মত সহকর্মীদের সহানুভূতি ও ভালোবাসা নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাবুল আক্তার চাকরি করার মত মানসিক অবস্থায় নেই। এটা যদি সত্যি হয়, পুলিশের পুরো বাহিনীর উচিত তার পাশে দাঁড়ানো, মানসিকভাবে সাহস জোগানো। দেশে, প্রয়োজনে বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তার বদলে তারা নিষ্ঠুরভাবে ছুঁড়ে ফেললো বাবুল আক্তারকে। বাবুল আক্তারের সাথে আচরণ পুলিশ বাহিনী সম্পর্কেই একটি ভুল বার্তা দেবে, অমানবিক বাহিনী হিসেবে পুলিশের দুর্নামের আরো বড় প্রমাণ হয়ে থাকবে এই ঘটনা। কোনো হত্যা মামলার বাদিকে জোর করে পদত্যাগ করানোর ইতিহাস সারাবিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্ত্রী খুন হওয়া তো কারো অপরাধ হতে পারে না। একজন ব্যক্তির চেয়ে একটি বাহিনীর ভাবমূর্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিরপরাধ বাবুল আক্তার যেমন চাকুরিচ্যুত হতে পারেন না, তেমনি কোনো ছাড় পেতে পারে না মিতুর হত্যাকারীরাও। আমরা অবিলম্বে বাবুল আক্তারের সন্দেহজনক পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে তাকে সসম্মানে চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। অথবা গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। মাঝামাঝি কোনো জায়গা নেই এখানে।probhash2000@gmail.comএইচআর/আরআইপি
Advertisement