শিরোনামের বাক্যশৃঙ্খলা সিংহ রাশির জাতক মিলনের। আমার সঙ্গে দেখা বা ফোনে কথা হলে, ওই বাক্যে কুশল ও বন্ধনের মাত্রা, নকল নয়, সাবলীল হাস্যে, যত্নে আমার শ্রবণে রোপণ করে মিলন।ওর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ৪১ বছর আগে, বাংলা একাডেমির বইমেলায়। পরস্পরকে বললাম আপনি। কিছুদিন না যেতেই দুজন দুজনকে বললাম তুই। মাঝখানের ‘তুমি’ টিকেছিল মাত্র ক’দিন। কখনো কখনো আমি ওকে ডেকেছি মিলমিলন বলে।সদা, ইতিবাচক অর্থে অস্থির, জীবনের চড়াই-উতরাইকে দেখা ও বোঝার ব্যাপারে সৃষ্টিশীল ঘরানার একজন মানুষ সব সময় চলাফেরায়, বসন-পরিধানে, শীলিত আচরণে গতিপূর্ণ ও প্রাণপূর্ণ থাকে কিভাবে? মিলনকে যতবার আমি দেখি, প্রশ্নটি আমাকে নিজের বাঁচার ভাবনায় সক্রিয় করে তোলে। আমি প্রতিক্রীয় হই।গত শতাব্দীর সাতের দশকটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত কী রকম ছিল তার ইতিহাস, দেশ সম্পর্কে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, কমবেশি অবহিত। ওই গড়া ও ভাঙনমুখী সময়ের মধ্যে, অধিকারের স্লোগান ও ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি শোনা, যুদ্ধে চরম অমানবিকতা দেখা এবং কার্তুজ ও বন্দুক ব্যবহার করা এক তরুণসমাজ যে গতিতে উত্থান ও পতনের সঙ্গী হয়েছিল, যার অনিবার্য ফল হওয়ার কথা ছিল কেবল ক্লেদ ও অন্ধকারমুখী যাত্রা। সেই দিকে না গিয়ে একদল তরুণ বেছে নিল এক কঠিন কাজের ব্রত। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক এবং গান লেখা ও ছবি আঁকার কাজে নিজেদের ডুবিয়ে দিয়ে তারা জীবনযাপন নামের টানেলের শেষ প্রান্তে খুঁজল আলো। মিলনের সাহিত্য বিষয়ে কেউ গবেষণামূলক কাজ যখন করবেন, এই প্রেক্ষিত তাঁকে মনে রাখতেই হবে। আশা ও হতাশার যৌথ রসায়নে বেড়ে ওঠা এক প্রজন্ম কোন কথা কিভাবে বলে ও আর্তনাদ কিভাবে করে, তার সত্যতা জানলেই, সঠিক ছবি গবেষণামূলক শব্দে ধারণ করা যাবে।শ্রমের কোনো বিকল্প নেই। সেই শ্রমিকতা যদি সৃষ্টিশীলতা ও ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তার জন্য উদয়াস্ত ঝরাতে হয় মানসিক ও শারীরিক ঘাম। কোনো রকম শিথিলতা সেখানে গ্রাহ্য নয়। অর্থনীতির ছাত্র, পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় বেড়ে ওঠা মিলন এক বিশেষ বয়সে বাস্তব ও স্বপ্নের আয়নায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছে তার আগামী কর্মজগৎ কী হবে। এবং নিজে, সম্ভবত মা-বাবা-ভাইবোনবেষ্টিত পরিবারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, বেছে নিয়েছিল একা চলার এক কাঁটাকীর্ণ পথ, যে পথে সাদা কাগজ আর কলম ছাড়া অন্নজাত ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মেটাবার এবং রোদবৃষ্টিতে আশ্রয় পাবার জন্য কিছুই থাকে না।মিলনের ব্যাপক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে এই লেখায় আমি আলোচনা করব না। স্বীকারোক্তিমূলক এক লেখায় মিলন নিজেই আমাদের জানিয়েছে, যেহেতু অন্য কোনো পেশা বেছে নেয়নি, সংসার চালাবার টাকার জন্য, বেঁচে থাকবার জন্য কেন বেশ কিছু সাধারণ মানের অন্য কথায় জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যকাজ তাকে করতে হয়েছে। আমি বাংলা ভাষার সাহিত্য পাঠকদের পড়তে অনুরোধ করব মিলনের উপন্যাস : ‘নূরজাহান’, ‘পরাধীনতা’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘কালোঘোড়া’, ‘মাটি ও মানুষের উপাখ্যান’, ‘যাবজ্জীবন’ এবং গল্পগ্রন্থ : ‘নিরন্নের কাল’, ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ ও ‘একাত্তুর’। পড়বার পর, পাঠকরা জানবেন ও মর্মে বুঝবেন, মিলন আমাদের সাহিত্যের অন্য মেজাজের এক লেখক।যদি আমরা ধরে নিই আঠারো বছর বয়সে, আগামী দিনের মূল কর্মজীবন হবে শুধুই লেখালেখি, মিলন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু করেছিল লেখার কাজ, তাহলে আজ এই ৬০ বছর বয়সে ও সব অর্থেই প্রমাণ করেছে, ৩৮ বছর আগে নেওয়া কর্ম-সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক। যদি পা হড়কাত, আমি যত দূর ওকে বুঝি, তখন দেখা যেত অন্য কোনো পেশায় মিলন নিজেকে সফল অর্থে দাঁড় করিয়েছে। অর্থাৎ সে কাজও ও করত, যেমন লেখালেখির জন্য করে, সমান পরিশ্রম ও নিষ্ঠা নিয়ে।কখনো কখনো মিলন বেশ মজা করে। পরীক্ষা করতে চায়, শ্রোতা বলা বিষয়কে কিভাবে নিচ্ছে। একবার শেরপুর থেকে ফিরে এসে আমাদের বলল, একজন তরুণী কবি ওর সঙ্গে রিকশায় চড়ে শহরে ঘোরার সময় বলেছিল, মিলনকে তার বাড়ি দেখাবে। কিন্তু বাড়ির সামনে দিয়ে রিকশা চলে যাবার সময়ও কবির মনে থাকে না মিলনকে বাড়ি দেখাতে। ওর কথা ও সাহচর্যে কবি সব কিছু ভুলে যায়।আরেক দিনের কথা। তখন গুন্টার গ্রাস ঢাকায়। গ্রাসভক্ত জনাব মাহবুব হোসেন খান ও তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ইফফাত আরা দেওয়ান তাঁদের বাসায় এক সন্ধ্যায় গ্রাসকে নিয়ে আড্ডার আয়োজন করেছিলেন। আমন্ত্রিতদের একজন ছিল মিলন। আমরা দু-একদিন পর সেই আড্ডার গল্প শুনলাম মিলনের কাছ থেকে। ইফফাত আরা গেয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীত। মিলন বলল, “জনাব খান, গ্রাসের সামনে শিভাস রিগালের বোতল রাখলে, গ্রাসের চোখ বড় হয়ে গেল।” কথাটি বলেই মিলন তাকাল আমাদের দিকে, বুঝতে চাইল, ওই পানীয় দেখে গ্রাসের চোখ বড় হয়ে যাওয়ার রসিকতাটা আমরা কিভাবে নিলাম।মনে পড়ে, মিলন তখন কবি রফিক আজাদের সঙ্গে সাপ্তাহিক রোববারে কাজ করত। ওর সমসাময়িক লেখক বন্ধুরা কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ যে যা-ই লিখুক না কেন, ও চাইত, যেন তারা নিয়মিত রোববারে লেখে। ওর এই চেষ্টার মধ্যে ছিল একটি লক্ষ্য, তা হলো, বন্ধুদের নিয়ে এক নতুন লেখকগোষ্ঠী গড়ে তোলা। অবশ্য এই পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে রফিক ভাইয়েরও ছিল পূর্ণ সহযোগিতা। একদিন আমাকে মিলন বলল, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই একটি গল্প দিতে হবে। আমি গল্প দিলে ও বলল, “কবিতা ও গল্প দুটোই লিখবি।” কিছুদিন আগে, গত বছরে, এক বিকেলে ওর সঙ্গে দেখা হলো রমনা পার্কে. হাঁটছিল, আমিও হাঁটছিলাম, বলল সেই আন্তরিক স্বরে : “কেমন আছ, হে বন্ধু।” কুশলপর্ব শেষ হলে বলল কালের কণ্ঠে কলাম লিখতে। এই রকম আহ্বানের কথা আরো বলা যেত, এখানে শুধু দুটো সখ্যের প্রসঙ্গ বললাম। অর্থ হচ্ছে, বন্ধুকে লেখক হিসেবে এগিয়ে নেওয়া।বড় ও উদার মনের মানুষ মিলন। ওর একটি প্রিয় শব্দ ‘চমৎকার’। কারো সম্পর্কে ও যখন বলে, বলে ‘চমৎকার মানুষ’, ‘বড়মাপের মানুষ’। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অকৃপণ ভাষায়। যা সত্য মনে করে, শোভন ভাষায় বলে দেয় মুখের ওপর। আÍসম্মান কিভাবে বজায় রাখতে হয়, তার কথা ওর লেখায় পড়েছি। একসময় চাকরি ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে ওকে থাকতে বলা হলো। ও পারস্পরিক শ্রদ্ধামাত্রা রেখে শ্বশুরবাড়ির পাশে ছোট বাসা নিয়ে যাপন করল জীবন।দেখতে দেখতে ৬০ বছর বয়স হয়ে গেল, তারুণ্যে সদা ঋদ্ধ মিলন! হোক। শুভ জন্মদিন। আমি নিশ্চিত, যত দিন ও বেঁচে থাকবে, ওর বেঁচে থাকা আমাদের সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন, সাদা কাগজ ও কলমকে মিলন রেহাই দেবে না কিংবা বলা যায়, ওই দুই বস্তু ওর শিল্পিত পীড়নপ্রেম দাবি করবেই।এইচআর/এমএস
Advertisement