বিনোদন

গান গেয়েই সংসার চালান অন্ধ গায়ক রেজা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসে প্রতিদিন বসেন না। ইচ্ছা হলে মাঝে মধ্যে ক্যাম্পাসের দিকে আসেন, সেটা মাসে একবারও হতে পারে। নিয়মিত বসেন রাজশাহী নগরীরর কাটাখালি বাজারে। একহাত দিয়ে গামলার উল্টো পাশে বাজান আর আরেক হাতে থাকে দর্শকের দেওয়া টাকা। একের পর এক গাইতে থাকেন নানা সময়ের আধুনিক গান।বলছিলাম রাজশাহী নগরীরর কাটাখালি এলাকার বাসিন্দা রেজাউল করিম রেজার কথা। ছোটোবেলায় এক রোগে তার দৃষ্টি শক্তি হারায়। পরে পরিবারের হাল ধরতে কাজের আর কোনো উপায় না পেয়ে শুরু করেন গান গেয়ে আয়-রোজগার করতে। তবে তার গান না শুনে কেউ টাকা দিতে চাইলে বেজায় খেপে যান। তিনি বলেন, ‘আমি ভিক্ষুক নই। সবার অন্য কাজের মতো গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। এটাই আমার কাজ। অন্য পেশাজীবীদের কাছ থেকে সেবা নিয়ে যদি অর্থ দিতে পারেন তবে আমাকে কেন নয়?’ক্যাম্পাসে বা কাটাখালি বাজারে একই রকম দৃশ্যে তাকে দেখা যায়। একটা নির্দিষ্ট স্থানে তিনি চট বা বস্তা পেতে বসেন। আর পাশে একটা ব্যানার রাখা থাকে। যেখানে লেখা রয়েছে, ‘দর্শক শ্রোতার প্রতি রইলো আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। দীর্ঘদিন যাবৎ আমি আপনাদের গান শুনিয়ে থাকি। মেহেরবাণী করে আমার গানগুলো শুনবেন। আমার জন্য সকলে দোয়া করবেন। আমিও আপনাদের সকলের জন্য দোয়া করবো।’সাত বছর বয়সে একটা রোগে (চোখ ওঠা) তার দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বা সামর্থ হয়নি তার চোখের চিকিৎসা করার। তবে তিনি স্বপ্ন দেখেন আবার পৃথিবী দেখার, নিজের দেশকে দেখার। তবে তা নিতান্তই খেয়ালিপনা। ‘আমার চোখ সৃষ্টিকর্তা তার ইচ্ছায় নিয়ে গেছে। আমি কারো অনুদানে বা চিকিৎসার মাধ্যমের দৃষ্টি ফিরে পেতে চায় না। যদি সৃষ্টিকর্তা চান তবেই.....’ এমনটাই ভাষ্য রেজার।দৃষ্টি শক্তি হারানোর পর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের একটা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি। কিন্তু তারপর তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সমর্থ হয়নি রেজার পরিবার। রেজাউল করিম রেজাসহ পরিবারের সদস্য এখন চারজন। স্ত্রী, সদ্য জন্মগ্রহণ করা পুত্র আর অসুস্থ মা। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে বাবা মারা গেছেন ২০১৩ সালে। গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও এতে নেই তার কোনো গুরু। ক্যাসেট বা সিডিতে গান শুনেই তিনি গান আয়ত্ব করেন।সারাদিন গান গেয়ে যা টাকা রোজগার হয় তাই দিয়ে সংসার চলে কেমন করে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি হাসিমুখেই উত্তর দেন, ‘দু-মুঠো ডাল ভাত খেয়ে দিন ভালোই যাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যেমন রেখেছে তাতেই আমি খুশি।’আপনি কোনো অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পান, তবে অংশগ্রহণ করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট উত্তর দেন, ‘না। আমি যে কটা দিন ওই অনুষ্ঠানের জন্য নষ্ট করবো, সেই কয়দিন আমার আয়-রোজগার বন্ধ থাকবে। আমার পরিবারের মুখে ডালভাত জুটবে না। যদি সেখান থেকে অর্থ পাই তবে যাবো। আমি গান ভালোবাসি। কিন্তু এই গান আমার রোজগারের একমাত্র পথ।’এই সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণির মানুষের উপর থেকে তিনি তার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যখন গামলা বাজিয়ে গান করি, তখন অনেকে এসে ছবি তোলে, ভিডিও করে নিয়ে যায়। এগুলো তারা তাদের নিজেদের কাজে লাগায়। আমাদের মতো অবহেলিত মানুষগুলো ওই ফুটপাতেই পড়ে থাকে। দু-বেলা খাওয়ার জন্য গলা চিরে গান করে।’  তিনি আর বিশ্বাস করেন না কেউ তার মতো শিল্পীর ভাগ্য বদলে দেবেন। যদি সত্যি কেউ দেন তারপর বিশ্বাস করবেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে গান করেছি, ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেনে গান করেছি, বিভিন্ন গণমাধ্যমে গান করেছি। কিন্তু সত্যি কথা হলো, দর্শক আমাদের গানকে মজা নেয়। মজা নেওয়া শেষ হলে আবার ঘরে ফিরে যায়। আমি তো চোখে দেখি না। গান শুনে হাততালি দিয়ে অনেকেই চোরের মতো পালিয়ে যায়।’এভাবেই ১৪ বছর ধরে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছেন রেজাউল করিম রেজা। স্বপ্ন দেখেন এভাবেই সৎ পথে রোজগার করে হাসিমুখে জীবন কাটনোর। স্বপ্ন দেখেন তার সদ্য জন্ম নেওয়া পুত্রও যেনো থাকে সারাজীবন সৎ পথে। পুত্র যেনো বাবার মতো গান গেয়ে উপহাসের পাত্র না হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।এলএ/এমএস

Advertisement