মতামত

কসাই কাসেমের মৃত্যুদণ্ড এবং জামায়াতের অর্থবিত্ত

‘একাত্তরের জল্লাদ’ ‘বাঙালি খান’, ‘কসাই’ ইত্যাদি নামে মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাসেম আলী পরিচিত ছিলেন। চট্টগ্রামে তার গ্রামের বাড়ি না হওয়া সত্ত্বেও একাত্তর সালে তিনি চট্টগ্রাম শহরেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ইসলামী ছাত্র সংঘের একজন নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন, বদর বাহিনী গঠিত হলে তিনি এর অন্যতম নেতার দায়িত্ব পান। ইতিমধ্যে ডালিম হোটেলে নির্যাতন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর দায়িত্ব পান মীর কাসেম আলী। এই ডালিম হোটেল হয়ে ওঠে বদর বাহিনীর তাদের নির্যাতন ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের মূল দায়িত্ব ছিল মীর কাসেমের হাতে। এই বাহিনী এখানে ধরে আনা বাঙালিদের নির্যাতন করতো, হত্যা করতো, নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতো। এই ক্যাম্পেই হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের ধরে এনে নানাভাবে নির্যাতন করার অসংখ্য বিবরণ চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন  থেকে জেনে এসেছে। কিন্তু কেউই কল্পনা করতে পারেনি ঐ সব হত্যাকাণ্ডের বা নির্যাতনের বিচার কেনোদিন কেউ দেখে যেতে পারবে। প্রতি বছর বিজয় দিবস এলে চট্টগ্রামে নানা অনুষ্ঠানে ডালিম হোটেলসহ বিভিন্ন নির্যাতন ক্যাম্পের মর্মস্পর্শী নির্যাতনের কথা বলা হতো, শোনা হতো। ডালিম হোটেলের নির্যাতনের হোতা হিসেবেও সেই সময় মীর কাসেম আলীকে বাঙালি খান, জল্লাদ, ‘কসাই’ ইত্যাদি নামেই সবাই অভিহিত করেছিল। সেই সব আলোচনায় এই বাঙালি খানের আদেশে কিশোর জসীমের ওপর অমানবিক নির্যাতন হওয়ার কথা মুখে মুখে তখন থেকে এখনও প্রচারিত হচ্ছে। জসীম নামক কিশোরটির মৃত্যুর কথা অনেকেই ভুলতে পারে নি। আরো অনেকের কথাই জানা আছে। কিন্তু এর বিচার কে করবে? এমন বাস্তবতাই তো দীর্ঘদিন বিদ্যমান ছিল। সুতরাং বিচারের বাণী নিভৃতে  কেঁদে বেড়িয়েছিল এতোদিন। অবশেষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে চট্টগ্রামের এই ‘বাঙালি খানের’ বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনীত বেশিরভাগ অভিযোগই প্রমাণিত হলেও পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষীর অভাবে বেশ কিছু অভিযোগের সাজা প্রত্যাশিত মৃত্যুদণ্ড হয় নি, তবে কিশোর জসীম হত্যার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। উচ্চতর আদালত সেই রায় বহাল রাখায় অবশেষে গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। মীর কাসেম আলী জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বদর নেতা, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ছাত্র শিবিরের প্রথম সভাপতি, এরপর জামায়াতের মূল অর্থবিত্তের রক্ষক। দলটি এই অর্থের প্রাথমিক প্রয়োজনীয় অংশটি এনেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। মসজিদ ও মাদ্রাসা তৈরির নাম করে নানাভাবে এই অর্থ সংগ্রহ করে দলটি বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক, বীমা হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে- যেখানে মৌলবাদের অর্থনীতি নামে একটি ধারণা তৈরি হয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে জামায়াত বিপুল অংকের টাকা দলীয় রাজনীতির প্রসার, ক্যাডার, সমর্থকদের ধরে রাখা, চাকুরি দেওয়ার মতো ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে অর্থবিত্তের দিক থেকে এখন এমন কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নেই যার সম্পদ ও অর্থ জামায়াতের ধারে কাছে যেতে পারে। সে কারণে জামায়াতকে বলা হয়, বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী আর এক এক বাংলাদেশ- যা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের একাত্তর বিরোধী বাংলাদেশের শক্তি- যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে গ্রাস করার অপেক্ষায় ছিল। যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে নাড়া না পড়লে জামায়াতের শক্তি আরো বৃদ্ধি পেত। সেই শক্তিকে প্রতিহত করা খুব সহজ হওয়ার মতো নয়। মূলত ধর্ম এবং অর্থ-এ দুটোই মানুষকে দুর্বল করার জন্য মস্তবড় অস্ত্র। জামায়াত ধর্মের নাম করে আশির দশক থেকে তরুণদের কাছে টানতে শুরু করে, পাশাপাশি জামায়াতের অর্থ ও বিত্তের অংশ বিশেষ কাজে লাগিয়ে লাখ লাখ নেতাকর্মী দলের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ দান করেছে। এর ফলে জামায়াতের রাজনীতি ভেতরে ভেতরে শক্তি অর্জন করতে থাকে। মীর কাসেম আলী এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দলীয় নীতি নির্ধারণী বিষয়কে বাস্তবায়ন করে চলছিলেন। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াত বিদেশি নানা লবিস্ট নিয়োগসহ প্রচার প্রচারণায় বিপুল অর্থ ব্যয় করে মীর কাসেম আলী এর মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে জামায়াত বিশ্বাস করেছিল যে, তারা এর বিপুল অর্থ ও বিত্ত খরচ করে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। বিচারকে ভণ্ডুল করতে পারবে। দেশে বিদেশে নানা মহলে শত শত কোটি টাকা এ উপলক্ষে বিনিয়োগও করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও কৌশলের কাছে জামায়াত পরাস্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল ভণ্ডুল করা সম্ভব হয় নি, পাকিস্তান ও তুরস্ক সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করলেও আরব বিশ্বের অন্য কোনো দেশ প্রত্যক্ষভাবে জামায়াতের পাশে দাঁড়ায় নি, মীর কাসেম আলীর পক্ষে পাকিস্তান বিবৃতি দিলেও তুরস্ক এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নি। বস্তুত জামায়াত যা আশা করেছিল তা শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করা কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই খুব একটা সম্ভব হচ্ছে না। জামায়াত এমনই এক ঘৃণিত শক্তি হিসেবে ১৯৭১ সালে মানুষ হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল যার পক্ষে সাফাই গাওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। তারপরও  অর্থের বিনিময়ে জামায়াত এতো বছর বিচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কিছু কিছু গোষ্ঠীকে  নিজেদের পক্ষে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াত তাদেরকে ধরে রাখতে পারে নি। এটির প্রমাণ মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর তেমন বড় ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া ওইসব  দেশ ও সংস্থা থেকে প্রকাশ না করা থেকেই প্রমাণিত। অন্যদিকে বিচার শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যেভাবে তাণ্ডব চালিয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল এই বিচার শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যাবে কি না। কিন্তু ছাত্র শিবিরের কর্মীদের আক্রমণাত্মক অবস্থানে এখন ভাটা পড়েছে। মনে হচ্ছে তারা কৌশল পরিবর্তন করেছে। তবে এর চাইতেও বড় সত্য, নতুন প্রজন্ম জামায়াত শিবিরের ন্যক্কারজনক রাজনীতি বুঝতে শুরু করেছে, ফলে তাদের রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের স্রোত আগের মতো বইছে না। এটি আরো বন্ধ হয়ে যাবে, যখন এর অর্থকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেবে যা থেকে নতুনরা বুঝতে শিখবে এই অর্থের উৎস যেমন মিথ্যাচার করে, এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের এবং সেই রাষ্ট্রের আদর্শ হবে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, পাকিস্তানমুখি যা বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা গ্রহণ করবে না যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিকভাবে শক্তিশালী হয়। এখন আমাদেরকে সেদিকেই নজর দিতে হবে, বাংলাদেশকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ, আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা দেশ রূপে যেখানে বেকারত্ব থাকবে না, অশিক্ষা, কুশিক্ষা থাকবে না, সুন্দর জীবন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। সেই প্রত্যয়েই চললেই জামায়াত প্রভাবিত জঙ্গিবাদী মৌলবাদী অর্থনীতি ও রাজনীতি থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হবে।লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্টএইচআর/পিআর

Advertisement