মতামত

রাজনীতি নয়, বিবেচনাটা হোক সুন্দরবন

রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক চলছিল। তবে এতদিন বিতর্কটা ছিল পরিবেশকেন্দ্রিক। কিন্তু হঠাৎ করেই তা ঘুরে গেছে রাজনীতির দিকে। গত ২৪ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার দাবি জানান। ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না এবং রামপালেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। এতদিন রামপাল ইস্যুতে পক্ষ ছিল দুটি: তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্যানারে সুন্দরবন বাঁচানোর আন্দোলন করছিল একটি পক্ষ, অপর পক্ষে ছিল সরকার। বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপিও একটি পক্ষ হিসেবে মাঠে নামে। যদিও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় কমিটির আন্দোলন আর বিএনপিকে এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করেছেন। তবে জাতীয় কমিটি জানিয়ে দিয়েছে, রামপাল ইস্যুতে বিএনপির সাথে মিলে আন্দোলন করার কোনো সুযোগ নেই।বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের হাত ধরেই রামপাল ইস্যুতে সরাসরি রাজনীতির প্রবেশ। তবুও বেগম জিয়াকে ধন্যবাদ অনেকদিন পর একটি জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে অবস্থান নেয়ার জন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবশ্য অনেকে মজা করে বলছেন, বেগম জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে রামপালের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলেই প্রধানমন্ত্রী এর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। যদি বেগম জিয়া রামপালের পক্ষে অবস্থান নিতেন, তাহলে সরকার এটি দ্রুত বাতিল করে দিতো। কৌতুক হলেও এটিই বাংলাদেশের রাজনীতির দুঃখজনক বাস্তবতা। সব বিষয়ে আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অবস্থান নির্ধারিত হয় ক্ষমতায় থাকা না থাকার ওপর। আজ বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় কমিটির সাথে সুর মিলিয়ে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু আজ থেকে ১০ বছর আগে এই জাতীয় কমিটিই দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলন করেছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তার সরকারের পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন জাতীয় কমিটির আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন।দুই নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনের একটা দারুণ বৈপরীত্য আছে। বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। আর শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই। তবে রামপাল ইস্যুতে একটা ব্যাপার আমাকে আনন্দ দিয়েছে। দুই নেত্রীর বক্তব্যই ছিল তথ্য-উপাত্তভিত্তিক। জাতীয় কমিটির নেতৃত্বও বক্তব্য রাখছেন তথ্য-উপাত্ত দিয়েই। রামপালের পক্ষে-বিপক্ষের সব যুক্তিই টেকনিক্যাল। আমরা আমজনতা সব কিছু ভালো বুঝিও না। আমাদের একমাত্র বিবেচনা সুন্দরবন। মূল নেতৃত্ব তথ্য দিয়ে, যুক্তি দিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেও তাদের অনুসারীরা অন্ধের মত পক্ষে-বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন। রামপাল ইস্যুতে গত ৯ আগস্ট জাগো নিউজে ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই, তবে অবশ্যই রামপালে নয়’ শিরোনামে আমার একটি লেখা ছাপা হয়। কিন্তু বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর হঠাৎ কিছু নয়া বিপ্লবীর আবির্ভাব ঘটে। তারা ফেসবুকে, ইনবক্সে নানাভাবে খোঁচাতে থাকে, আমি বা আমরা কেন রামপাল ইস্যুতে চুপ করে আছি। আবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরও কিছু অতি বিপ্লবীর দেখা মিলছে, যারা বলার চেষ্টা করছে, সুন্দরবন এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে বিদ্যুৎ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর যেখানেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হোক, পরিবেশের কিছু না কিছু ক্ষতি হবে। রামপালে হলে না হয় সুন্দরবনের ক্ষতি হবে, ঝুঁকিতে পড়বে বন্যপ্রাণী। কিন্তু অন্য জায়গায় হলে ঝুঁকিতে পড়বে মানুষ। তাই তাদের মতে যে কোনো মূল্যে রামপালেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে হবে। আবার জাতীয় কমিটির উগ্র সমর্থকদের কেউ কেউ রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলেই রাতারাতি সুন্দরবন উজাড় হয়ে যাবে, সুন্দরবনে এসিড বৃষ্টি হবে- এমন আজগুবি কথা বলছেন। প্রশ্নোত্তর পর্ব বাদ দিলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনটি ছিল অসাধারণ। তিনি রামপালেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি করার পক্ষে সরকারের অবস্থান যৌক্তিকভাবেই তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, রামপালে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলেও সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। শেখ হাসিনা সবাইকে অনুরোধ করেছেন, তাঁর ওপর আস্থা রাখতে। সুন্দরবনের ক্ষতি হয়, এমন কিছু তিনি করবেন না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখছি। কিন্তু তারপরও সুন্দরবন নিয়ে শঙ্কাটা কাটছে না। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ক্ষতি হয়তো কম হবে, কিন্তু সুন্দরবনের ক্ষতি হবেই না, এটা মানতে পারছি না। বিশেষ করে চট্টগ্রামে অ্যামোনিয়া দুর্ঘটনার পর শঙ্কাটা আরো বেড়েছে। দুর্ঘটনা তো রামপালেও ঘটতে পারে। তাই সুন্দরবন নিয়ে কোনো ঝুঁকি আমি নিতে চাই না, কারণ সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। তারচেয়ে বড় ঝুঁকিটা অন্য খানে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে একে ঘিরে সুন্দরবনের পাশে যে বেসরকারি শিল্প জাগরণ ঘটবে, তার থাবা থেকে সুন্দরবনকে বাঁচাবে কে? রামপাল তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, কিন্তু বেসরকারি শিল্প-কারখানাকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? ইতিমধ্যেই রামপালের আশপাশের সব জমি কিনে নিয়েছে বেসরকারি উদ্যোক্তারা। দূষণ রোধে শিল্প-কারখানায় ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও অনেক শিল্পমালিকই তা মানেন না। ফলে শিল্প-বর্জ্যে মরতে বসেছে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো। চোখের সামনে বুড়িগঙ্গাই আমরা বাঁচাতে পারছি না, আর অতদূরের সুন্দরবন বাঁচাবো কিভাবে? তাই সুন্দরবন নিয়ে আমার আগের অবস্থানে নড়চড় হয়নি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই, তবে অবশ্যই রামপালে নয়।যে কোনো উন্নয়ন কাজেই পরিবেশের কম বেশি ক্ষতি হবে। অগ্রগতির স্বার্থে এটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু অন্য সব ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বের জন্যই এক প্রাকৃতিক আশীর্বাদ। তাই সুন্দরবন নিয়ে বাজি ধরার কোনো সুযোগ নেই। রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার ব্যাপারে সরকার দৃঢ় হলেও অনড় নয়। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জাতীয় কমিটির নেতাদের সাথে কথা বলেছেন। সংসদীয় কমিটিও জাতীয় কমিটির নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে কথা বলেছেন। জনমত বিবেচনায় নিয়ে সরকার এখনও রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে। পিছিয়ে আসা মানেই পরাজয় নয়। রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে যেন রাজনীতি নয়, একমাত্র বিবেচনা হয় সুন্দরবন। বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মত আরো অনেক জায়গা আছে বাংলাদেশে। কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই।৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬probhash2000@gmail.comএইচআর/এবিএস

Advertisement