শিরোনাম পড়ে মন খারাপ আপনার হতেই পারে, এমন শ্রুতিকটু একটি প্রশ্ন তোলার জন্য মনে মনে আপনি আমাকে গালিও দিতে পারেন। কিন্তু আপনি কি আমাকে এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারবেন, রিশার পরে আর কারো জন্য আমাদের `বিচার চাই` লেখা প্লাকার্ড নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়াতে হবে না, আমাকে আর এমন শ্রুতিকটু, তিক্ত কোনো শিরোনাম দিয়ে লিখতে হবে না, এদেশের প্রত্যেক কিশোরী, প্রত্যেক নারী, প্রত্যেক মানুষ নিরাপদে থাকবেন? জানি পারবেন না। তনুর হত্যার পরও আমরা আশা করেছিলাম, আর কোনো তনু হারাবে না, নিশ্চয়ই হারাবে না। কিন্তু তনুরা হারিয়েছে। তনুরা হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ ভবিষ্যতদ্রষ্টা নয়, তবু আমি জানি, তনুরা হারাবে। এদেশে খুনি ওবায়দুল একা নয়। তার মতো আরো অনেক গুপ্ত ওবায়দুল লুকিয়ে আছে। সুযোগ বুঝে বের হয়ে আসবে আর রিশাদের প্রাণ কেড়ে নেবে, আমার বোনের প্রাণ কেড়ে নেবে, আপনার সন্তানের প্রাণ কেড়ে নেবে। রিশা যেমন কারো সন্তান, ওবায়দুলও তো কারো সন্তান। কোনো এক মা তাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে। ছেলেবেলায় ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। জোসনা রাতে হয়তো উঠোনে পাটি পেতে রূপকথার গল্প শুনিয়েছে। যে ছেলেটি মাকে পাশে না পেলে জুজুবুড়ির ভয়ে ঘুমুতে পারতো না, সেই ছোট্ট ছেলেটি বড় হতে হতে একদিন খুনি হয়ে গেল! সেই ছেলেটিই আরেকজন মায়ের বুক খালি করে দিলো! একজন নিরপরাধ তরতাজা কিশোরীকে লাশ বানিয়ে দিলো! কোনো মা চান না তার সন্তান খুনি হোক। তবু এদেশে ওবায়দুলরা খুন করে, খুনি হয়। অতিরিক্ত মাতৃস্নেহ, প্রশ্রয়, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব, আইনের সুশাসনের অভাব, সুশিক্ষার অভাব ধীরে ধীরে ওবায়দুলদের গড়ে তোলে। ওবায়দুলরা যদি দেখতে পেতো, তনুর খুনিদের বিচার হয়েছে, আফসানার খুনিদের বিচার হয়েছে, জনিয়ার খুনিদের বিচার হয়েছে, তবে আর কোনো ওবায়দুল গড়ে উঠতো না। একটি অন্যায়ের প্রশ্রয় ও বিচারহীনতা সুযোগ করে দিচ্ছে নতুন অপরাধীদের। নতুনের আগমনে পুরাতনরা জায়গা ছেড়ে দেয়। আপনারা কার জন্য জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন? রিশার জন্য? রিশারা তো খুন হয়ে যাচ্ছে! ওবায়দুলদের জন্য? ওবায়দুলরা তো খুনি হচ্ছে! খুন এবং খুনির ভিড়ে সত্যিই কি আরেকটি প্রজন্ম মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? নাকি ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত পবিত্র এই দেশ, এই প্রিয় জন্মভূমি খুনির রাজ্য হিসেবে পরিচিত হবে? মানুষ জন্ম থেকে শিখেপড়ে পৃথিবীতে আসে না। আপনারা ওবায়দুলদের শেখান। তাদের মানুষ করুন। একজন মানুষ একটি দেশের সম্পদ। দেশের অর্ধেক সম্পদ খুন হয়ে গেলে এবং অর্ধেক সম্পদ খুনি হয়ে গেলে অমানুষের মানচিত্র দিয়ে আমরা করবোটা কী! আমরা অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দের মালা গেঁথে যাবো। পাঠকেরা পড়ে মন খারাপ করবেন, কাঁদবেন, খুনিদের অভিশাপ দেবেন- এভাবেই কি চলতে থাকবে? রিশার মায়ের, রিশার বাবার, রিশার প্রিয়জনদের অবস্থানটি একবারও বুঝতে চেষ্টা করছেন? বুঝতে পারছেন না? না পারারই কথা। যার বেদনা, একমাত্র তার পক্ষেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব। চিন্তার কোনো কারণ নেই। রিশার পরেই যার নামটি, সেটি হতে পারে আপনারই কোনো প্রিয়জন, আপনার বোন, আপনার প্রিয়তমা, আপনার কাছের কেউ! তখন না হয় উপলব্ধি করে নেবেন! এসব পড়ে আমাকে গালি দিচ্ছেন? দিন! রিশার পরের নামটি যদি আমার হয় তবে আজকের পর হয়তো গালি দেয়ার জন্যও আমাকে খুঁজে পাবেন না! তখন আপনারাই প্লাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়াবেন - `জাস্টিস ফর হাবীবাহ্`!রিশার মৃত্যুর পর তার জন্য যারা কেঁদেছে তাদের সবাই নারী নয়। রিশার সহপাঠী অনেককে কাঁদতে দেখা গেছে, যাদের মধ্যে বেশকিছু ছেলেও ছিল। এই দেশের ছেলেরা খুনি হয়, এই দেশের ছেলেরাই মৃত সহপাঠীর জন্য হাউমাউ করে কাঁদতে জানে। একটা ক্ষীণ আশা এখনও দেখা যাচ্ছে- খুনিদের থেকে ভালোবেসে কাঁদতে জানা মানুষের সংখ্যা এখনও বেশি। এই সংখ্যাটা আরো বাড়ুক। এতটাই বাড়ুক যে আর কাউকে যেন কাঁদতে না হয়, কাঁদানোর জন্য আর কোনো খুনির যেন জন্ম না হয়। আমরা বিশ্বাস করবো, আমাদের চারপাশে যে নিরপরাধ শিশু, কিশোরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কেউ কখনো খুনি হবে না। তারা জীবনকে ভালোবাসবে, মানুষকে ভালোবাসবে, পৃথিবীকে ভালোবাসবে। ভালোবাসাময় পবিত্র এক পৃথিবীর বুকে আলাদা করে জ্বলজ্বল করবে একটি নাম - `বাংলাদেশ`!লেখক : কবি, সাংবাদিকএইচআর/আরআইপি
Advertisement