জন কেরির ঢাকা সফর নিয়ে সাধারণের আগ্রহ ছিল। তবে আমার কেন যেন এবার কাভার করতে গিয়ে মনে হলো, আগ্রহটা নির্মোহ হয়েছে। এর আগে হিলারি ক্লিনটন এসেছেন ঢাকায়। আরও অনেকবছর আগে বিল ক্লিনটনও। তখন মনে আছে প্রায় দুদিন ধরে অবরুদ্ধ হয়েছিল ঢাকা। এয়ারপোর্টে বিল ক্লিনটনের হাত নাড়া থেকে প্রতিটি স্টেপ টেলিভিশনে আগ্রহ ভরে দেখেছে মানুষ। "সব পেয়েছির দেশ" নিয়ে মানুষের মোহ কমেছে। আমেরিকান ভিসা নামের সাত রাজার ধনও এখন এদেশের মোটামুটি সামর্থ্যবান মানুষদের কাছে এভেলেবল হয়েছে। মোদ্দা কথা, ঘোর ঘোর চোখে আমেরিকা কে দেখার দিন শেষ হয়েছে। কিভাবে শেষ হলো?লক্ষ্য করি, সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি প্রায় ইররেলিভেন্ট করে ফেলা হয়েছে। করেছেন বিভিন্ন তাত্ত্বিকরা। গত কয়েক শতাব্দী ধরে বারবারা ওয়ার্ড বা ডব্লিউ রস্টোর এর মতো লেখকরা বলে আসছেন যে প্রযুক্তি প্রদান এবং যথাযথ কর্ম অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে দক্ষিণ গোলার্ধের "পশ্চাৎপদ" দেশগুলোকে উদ্ধারের মহান দায়িত্ব হচ্ছে আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলোর। এই সাম্রাজ্যবাদী ফ্যান্টাসি কিন্তু আমরা অস্বীকার করতে শিখেছি। এবং সাম্রাজ্যবাদ আমরা মোটেও ভুলি নাই। আমরা কিভাবে চাষবাস করবো, কিভাবে মাছ ধরবো, কিভাবে আমাদের দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শিখবে, পুষ্টিকর খাবার আমাদের প্রসূতি মায়েরা কিভাবে খাবে এবং কিভাবে আমাদের পুলিশ জঙ্গি বা সন্ত্রাসী ধরবে তা শেখানোর জন্য আমেরিকার ছবকের প্রয়োজন আমাদের আছে কি না তা নিয়ে আমরা যাচাইবাছাই করেছি। ইনফ্যাক্ট করতে শিখেছি। আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি আমরা জানি। আমাদের একেবারে গ্রামের মানুষটিও জানে। এলিটদের স্বার্থ রক্ষায় সফল আর নৃশংস সেসব নীতি। এখন উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে আমরা যে মোটামুটি শক্ত একটা অবস্থানে গিয়েছি সেই অবস্থানই কিন্তু সমানে সমান আলোচনার টেবিলে বসতে সহায়তা করেছে।কেরির বার্তা ঠিকঠাক গণমাধ্যম জানাতে পেরেছে কি না জানিনা। হয়তো অনুচ্চারিত অনেককিছুই রয়ে গেছে। কিন্তু ৩২ নম্বরে কেরি যখন আবেগাপ্লুত মন্তব্য লেখেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলেটারাল বৈঠক শেষে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বলেন, "আমরা তাঁকে বলেছি, প্রায়ই তো এদিক দিয়েই উড়ে যান নেমে পড়লেই তো পারেন! তিনি বলেছেনও আবার আসবেন।" তখন দেশের মানুষের মধ্যেও একধরনের নির্ভার বোধের জন্ম হয়। এবার আসি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে। বাংলাদেশি পণ্যের ডিউটি ফ্রি কোটা ফ্রি এক্সেস চেয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে সহায়তাও। জন কেরি নোট নিয়েছেন নিশ্চয়ই। পরে বাণিজ্যমন্ত্রীও বললেন, এই সুবিধা চাওয়ার কথা। এবং চাওয়ার এ্যাপ্রোচটাও লক্ষ্য করেন। কোনো দয়া কিন্তু চাননি প্রধানমন্ত্রী। আফ্রিকার কিছু দেশে এই সুবিধা দেয় আমেরিকা আমরাও পাওয়ার যোগ্যতা রাখি সেই হিসেবে চেয়েছেন। জিএসপি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বাণিজ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছেন। কারণ কূটনীতিকরা বুঝেছেন আপাতত; এই জিএসপি তারা দেবে না। এ্যালায়েন্স এর সব শর্ত ধীরে ধীরে পূরণ হচ্ছে তবু তারা প্যাঁচাচ্ছে। তা প্যাঁচাক। আমরা এগুচ্ছি আমাদের মতো করে। এখন কথা হলো, পুরো সফরটা নিয়ে সরকার কি খুব উত্তেজিত? তাও কিন্তু আমার মনে হয়নি। খুবই স্বাভাবিক নর্মস এর সাথে পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ হয়েছে। কূটনীতিতে বডি ল্যাংগুয়েজের যে কথা আমরা শুনে এসেছি তার প্রকাশও ছবিতে দেখেছি। একটা দেশের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতা আরেকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বীনিত ভঙ্গি।সবকিছুকে গ্লোরিফাই করার একটা অভ্যাস আমাদের আছে। সমাজে ভালো এবং স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা অচেনা ছিল বলে এই অবস্থা। ধরেন ব্যাগভর্তি টাকা পেয়ে কোনো দরিদ্র ব্যক্তি তা ফেরত দিলে সেটা "নিউজ" করার, সেটাকে "ধন্য ধন্য" করার সেই অভ্যাস। অথচ অন্যের টাকা পড়ে গেলে সেটা কুড়িয়ে পেলে ফেরত দেয়াই স্বাভাবিক নৈতিকতা, এখানে ধন্য ধন্য করার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিকতা। আমরা দেশ হিসেবে কারো সাথে অতি নতজানু নই আবার আজকের যুগে প্রবল বিরোধিতার জায়গাও নেই। যেকোনো দেশের সাথে সেটা আমেরিকা হোক বা আফ্রিকার কোনো দেশ- টেবিলে শিরদাঁড়া টান করে বসতে পারি। এটা আমাদের অভ্যাস করে ফেলা উচিত এখনই, গ্লোরিফাই না করে। অক্টোবরে চীনের প্রধানমন্ত্রী আসছেন। আমাদের শিরদাঁড়া এরকমই টানটান থাকবে, বিশ্বাস এটা আমাদের। ধীরে ধীরে গ্লোরিফাই করার ছেলেমানুষীও আমাদের চলে যাবে বলে আশা করি।লেখক : কূটনীতিক রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজএইচআর/পিআর
Advertisement