মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাসেম আলীর সব আইনি লড়াই শেষ। এখন রাষ্ট্রপ্রতির কাছে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার সুযোগ ছাড়া ফাঁসির রজ্জু থেকে বাঁচার তার আর কোনো উপায় নেই তার। তবে দেশের মানুষ রিভিউ খারিজ হওয়ার পর স্বস্তি প্রকাশ করেছে। এখন যত দ্রুত সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফাঁসি কার্যকর করা যায় ততোই কলঙ্কমোচনের পথ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। মীর কাসেম আলী একাত্তরে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বাহিনী আলবদর গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলী ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি এবং চট্টগ্রাম আলবদর বাহিনীর কমান্ডার। তারই নেতৃত্বে ও রাজাকারদের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার পুরাতন টেলিগ্রাফ অফিস হিল রোডের মহামায়া ডালিম হোটেল, আছদগঞ্জে মোহাম্মদ পাঞ্জাবির ভবনের চামড়ার গুদাম, পাঁচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল প্রভৃতি জায়গায় নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও সে জড়িত। একাত্তরের গণহত্যায় মীর কাসেমের অপরাধের মাত্রা বুঝা যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ডালিম হোটেলকে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে । এছাড়া নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার কারণে চট্টগ্রামবাসী মীর কাসেমের নাম দিয়েছিলেন ‘বাঙালি খান’। জামায়াতের শরীরে অর্থবিত্তের রক্ত প্রবাহের অন্যতম ভূমিকা পালন করে এই যুদ্ধাপরাধী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সমাজে এরা পুনর্বাসিত হতে পেরেছিল। যার ফলে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও হয়েছিল মীর কাসেম। দিগন্ত মিডিয়াও তারই প্রতিষ্ঠান। অর্থ যে অপরাধ থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না মীর কাসেম আলীর ফাঁসি বহাল থাকার মধ্য দিয়ে তা আবারো প্রমাণিত হল। যুদ্ধাপরাধের বিচারে একের পর এক চিহ্নিত ঘাতকদের সাজা হওয়া এবং তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশ কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। এরপর সেই অঙ্গীকারের প্রতি জনরায় পেয়ে দলটি সরকার গঠন করে। শুরু হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া। দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করা হয়। ইতিমধ্যেই অনেকরই বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, কামারুজ্জমান, সাকা চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর করা হয়েছে। এখন বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও যাতে শেষ করা যায় সেটিই প্রত্যাশা করছেন একাত্তরে স্বজন হারানো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষজন।যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিটি দীর্ঘদিনের। কিন্তু স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একাত্তরের ঘৃণ্য অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সামরিক শাসক জিয়া ক্ষমতা দখল করে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীকে আবার রাজনীতি করার সুযোগ দেন। এ সময় কারাগারে বন্দি অনেক যুদ্ধাপরাধীকেও ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে রাজনীতিতে তারা আসন পাকাপোক্ত করে। খালেদা জিয়ার জোট সরকারে নিজামী-মুজাহিদ মন্ত্রীও হন। কিন্তু দেশের মানুষ সেটি মেনে নেয়নি। তারা সব সময়ই চেয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার।একাত্তরে স্বজন হারানোর বেদনা লাঘব করাই শুধু নয়, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও যুদ্ধাপরাধের বিচার করা অত্যন্ত জরুরি। অপরাধ কখনো তামাদি হয় না, এবং অপরাধ করলে কেউ পার পায় না- এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সমাজে নীতি নৈতিকতার উন্মেষ ঘটে। এ কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোনো বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শোষণহীন, বঞ্চনাহীন, সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করার প্রক্রিয়ায় এগুনোরও পথও পরিষ্কার হবে যদি স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে চিরতরে নির্মূল করা যায়। এইচআর/এমএস
Advertisement