বিশেষ প্রতিবেদন

যার স্পর্শে সুস্থ হচ্ছে হাজারো গরিব শিশু

ধনি, গরিব সবাই তাকে চেনেন গরিবের ডাক্তার হিসেবে। কারণ কোনো গরিব রোগীর কাছ থেকে তিনি ভিজিট নেন না। মায়ের নির্দেশই ছিল এমন যে, কোনো গরিব মানুষের টাকা তোর পকেটে ভরবি না। তাই তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে মায়ের সেই আদেশ মেনে চলছেন। তবে ধনিদের কাছ থেকে তিনি তার নির্ধারিত ভিজিট রাখেন।গরিবদের কাছ থেকে তিনি শুধু ভিজিট নেন না শুধু তা নয়, এরকম অসংখ্য কাহিনী আছে এই মানুষটিকে নিয়ে। যা পড়লে আপনার কাছে মনে হবে কোনো রূপকথার গল্প পড়ছেন। হাসপাতাল থাকা অবস্থায় বারান্দায় কোনো বৃদ্ধ/বৃদ্ধাকে তিনি ছুটতে দেখলেই বুঝে নেন কোনো একটা সমস্যা আছে। তা দেখে নিজেই কাছে গিয়ে ঘটনা জানতে চান এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করেন ওই মানুষটিকে সবার আগে চিকিৎসা দেয়ার। সেটা যে রোগীই হোক না কেন। গরিব রোগীদের কাছ থেকে তিনি ফি তো নেনই না বরং অনেক রোগীকে ওষুধও কিনে দেন। সম্ভব হলে বাড়ি যাওয়ার সময় অনেককে গাড়ি ভাড়াও দেন। এভাবেই চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন ঠাকুরগাঁওয়ের এক মহামানব। এতক্ষণ যে মানুষটির বর্ণনা করলাম তিনি হলেন ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাহান নেওয়াজ। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে মহান এই মানুষটি ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল ও নিজ বাসভবন শহরের হাজীপাড়ায় এভাবেই মানুষের সেবা করে গরিবের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। শুধু কি গরিব, সব শ্রেণির মানুষের কাছে এই মানুষটির মূল্যায়ন গরিবের ডাক্তার হিসেবে। সার্বক্ষণিক হাসিমাখা মুখটি নিয়ে যেদিকেই যান সেদিকেই শুভাকাঙ্খি দিয়ে ভরপুর।তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে সন্তান দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছে এমন অসংখ্য মা-বাবা তার বাড়ির পোষা প্রিয় মুরগি অথবা ছাগল নিয়ে হাজির হয়েছেন তার বাড়িতে। অসংখ্য কাহিনী আছে এই মানুষটির জীবনে।২০১০ সালের ঘটনা। হাসপাতালের বারান্দায় দেখা হয় এক বৃদ্ধার সঙ্গে। সেখানে মাথাটা নেড়ে দিয়ে বলল, আর কত মানুষের সেবা করিবো, এলা (এখন) হজ করিবা যা। হজটা তোর তানে (জন্য) ফরজ। হজ থেকে আইসে মানুষের সেবা কর কামত (কামে) দিবে।এ কথা বলেই তিনি চলে যান। হয়তো কোনো দিন রোগী নিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে তাই মনে রেখেছেন। তার এই কথা ওই রাতে বার বার মনে পড়েছে। পরদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম হজে যাবো। আল্লাহর অশেষ রহমতে হজ করে এসে আজো মানুষকে সেই আগের মতো সেবা দিতে পারছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখটা সম্ভবত মানুষকে সেবা দেয়ার মাঝে দিয়ে রেখেছেন আল্লাহ এমনটাই বললেন তিনি।মঙ্গলবার বিকেলে ঠাকুরগাঁও শহরের নিজ বাসায় রোগী দেখার সময় শত ব্যস্ততার মাঝেও মোবাইল ফোনে এভাবেই জাগো নিউজের কাছে জীবনের উল্লেখযোগ্য কাহিনীগুলো স্মৃতিচারণ করেন ডা. শাহজাহান নেওয়াজ।২৭ বছরের চিকিৎসা জীবনে মনে পড়ার মতো এমন আর কোনো কাহিনী আছে কি আপনার, যা আজো আপনাকে নাড়া দেয়। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, একদিন সকাল ৮টায় হাসপাতালে গিয়ে দেখি এক বৃদ্ধা দাদি তার ফুটফুটে নাতনিকে নিয়ে ওয়ার্ডে খুব হাসিমুখে গল্প করছেন অন্য রোগীদের সঙ্গে। সেখানে তারা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। অথচ আগের দিন রাতেই নাতনির খুব পেট ব্যথা ছিল। সকালেই সে সুস্থ হয়ে গেছে। তাদের কাছে যাওয়া মাত্রই মুখে তৃপ্তি ও কৃতজ্ঞতার হাসি নিয়ে বলল, বাউ এলা তো হামার (আমার) নাতনি সুস্থ। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবা (যেতে) হবে। খুব ভোক (ক্ষিধা) লাগিচে। গত কাইল রাত থেকে কিছু খাও নাই। উনার ওই কথা শুনেই চোখে পানি এসেছিল সেদিন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। পেটে ক্ষুধা নিয়েও মানুষ এতো তৃপ্তির হাসি হাসতে পারে এটা ওইদিনই প্রথম দেখেছি। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা নিয়েছি সেদিন তাদের কাছে, কষ্টের মাঝেও কীভাবে হাসতে হয়।তিনি বললেন, আমরা যারা একটু সম্পদশালী সামান্য ব্যাপারেই রেগে যাই। অথচ গরিব মানুষগুলো শত অভাব-অনটনের মাঝেও মুখে হাসি নিয়ে ঘুরছে ফিরছে। আমরা খুব সহজেই আমাদের ক্লান্তিটা প্রকাশ করতে চাই। অথচ ওই মানুষগুলোর হাসি দেখলে মনে হবে তাদের কোনো কষ্ট নেই।এত খ্যাতি ও সুনামের পেছনের কাহিনী জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো রোগী আমার কাছে এলেই জানতে চাই, বাবা-মা কি করে। পরিবারের সদস্য সংখ্য কয়জন। স্কুলে যায় কিনা। এসব শোনার পর যখন বুঝতে পারি তিনি অভাবি মানুষ। তখন আঞ্চলিক ভাষাই কথা শুরু করি। এরপর আস্তে আস্তে পরিবারের সকল কষ্টের কথাগুলো শেয়ার করা শুরু করে তারা। এভাবেই গরিব মানুষগুলো চিহ্নিত করি। এরপর আর ভিজিট নেই না। সম্ভব হলে ওষুধ কিনে দেয়ার ব্যবস্থা করি। যদি শুনি অনেক দূর থেকে এসেছেন চেষ্টা করি তাদের গাড়ি ভাড়া দেয়ার। আসলে গরিব মানুষগুলোর একটু উপকার করলেই তারা অনেক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। তাদের কারণেই হয়তো আল্লাহ আমাকে আজ এত কিছু দিয়েছেন।শিশুদের নিয়ে কোনো স্বপ্ন আছে কি, জানতে চাইলে বলেন, স্বপ্ন একটা আছে আপাতত গোপন রাখছি। পূরণ করার পর জানাবো। যা করছি আমার মায়ের তৃপ্তির জন্যই করছি। কারণ তিনি চাইতেন গরিবের কোনো টাকা যেন আমার পকেটে না আসে। মায়ের সেই কথা রাখার চেষ্টা করছি।সম্প্রতি ডাক্তার হওয়ার পেছনের কাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে তিনি লিখেছেন, আমাকে আবারও যদি সেই উচ্চ মাধ্যমিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আমি সুনির্দিষ্টভাবে এই পেশাটিকেই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতাম। পাঠকের জন্য তার লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো :দ্বাদশ শ্রেণিতেও জীববিজ্ঞান ছিল আমার চতুর্থ বিষয়। গণিতটাই ভালো লাগতো বেশি। আমার ইচ্ছাই ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু আমার মায়ের খুব ইচ্ছে, ছেলে ডাক্তার হবে। মায়ের ইচ্ছের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মেডিকেলে পরীক্ষা দেই । এবং টিকেও যাই। মাকে খুশি করার জন্যে শেষমেশ মেডিকেলেই ভর্তি হই।কোনো দিনও ভাবিনি পেডিয়াট্রিশিয়ান হবো। মেডিকেলে পড়ার সময় ভাবতাম কার্ডিওলজি নিয়ে পড়বো। কার্ডিওলজির এক বিখ্যাত স্যারের পেছনে অনেকদিন ঘুরলাম। খুব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু শেষে দেখা গেল কার্ডিওলজি নিয়েই আর পড়া হলো না।অনিচ্ছা সত্যেও পেডিয়াট্রিক্সেই ভর্তি হলাম। তখনও বুঝিনি পেডিয়াট্রিক্স আমাকে মানুষের এতো কাছাকাছি করে দেবে। আজ প্রায় সাতাশ বছর যাবত ঠাকুরগাঁও-এ বসেই শিশুদের চিকিৎসা করছি। আমার এ কথাগুলো যারা পড়ছেন তাদের অধিকাংশই আমার শিশু পেশেন্ট ছিলেন, আমি নিশ্চিত।এই পেশায় কতটা দিতে পেরেছি জানি না। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, আমি গরিব পরিবারগুলোর কাছে পয়সা নেই না কেন। আমি বলি, সৃষ্টিকর্তা আমাকে চাকরি দিয়েছেন, বাড়ি দিয়েছেন। আমার মনে হয় না আমার আর কিছু লাগবে। কিছু পয়সা বাঁচিয়ে যদি তারা ওষুধটুকু কিনতে পারে, এটুকুতেই আমার শান্তি। মেডিকেল জীবন থেকেই মানুষের এ কষ্টগুলো আমাকে পীড়া দিত।আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যতটা পারছি করে যাচ্ছি। এই পেশায় এতোগুলো বছর সেবা করে আমি মানসিকভাবে যথেষ্ট পরিতৃপ্ত। আমাকে আবারও যদি সেই উচ্চ মাধ্যমিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আমি সুনির্দিষ্টভাবে এই পেশাটিকেই বেছে নিবার সিদ্ধান্ত নিতাম।বাকি জীবন ঠাকুরগাঁও-এ থেকেই শিশুদের চিকিৎসা করে যেতে চাই।এমএএস/আরআইপি

Advertisement