খেলাধুলা

অংশগ্রহণই যখন গর্বের

কোপাকাবানা বিচ পর্যটকদের কাছে কিংবদন্তী। পাশেই ইপেনেমা, সেটা পেরিয়ে গেলেই লেবলন সৈকত। ঢাকার ‘বনেদিয়ানা’ কালান্তরে ধানমন্ডি-ওয়ারি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে সরে গেছে গুলশান-বারিধারায়। কোপাকাবানার চেয়ে এখন যেমন লেবলনের বিলাস-ব্যসন বেশি। তবে কিংবদন্তী তো অমর। ধানমন্ডি-ওয়ারি এখনো নস্টালজিয়ায় আক্রান্দ করে। রিও ডি জেনেইরোর পর্যটকদের সব পথও গিয়ে মেশে কোপাকাবানায়। তো, সাত তলা ফ্ল্যাটের জানালা খুললেই সেই কোপাকাবানার সৈকতে আটলান্টিকের আছড়ে পড়া ঢেউ দেখা যায়, দিনে-রাতে সব বেলায়। অলিম্পিক কাভার করতে আসা কোন সাংবাদিকের জন্য এরচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী প্রতিবেশ আর কি হতে পারে?এরচেয়ে বেশি কিছু চাওয়ারও নেই। অন্তত অলিম্পিকে আমার মত ফার্স্টটাইমারদের জন্য তো অবশ্যই। প্রায় দুই যুগের ক্যারিয়ারে কমবেশি সফর করার সুযোগ হয়েছে। সে যত নতুন দেশই হোক না কেন, কখনো ঘাবড়াইনি। ক্রিকেট বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ, এশিয়ান গেমস, সাফ গেমস, সাফ ফুটবল; একেবারে অনভিজ্ঞ বলা যাবে না কোনভাবেই। তবু রিও অলিম্পিকের প্রতিটা মূহূর্ত মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘ওহে, এ আসরে তুমি দুধের শিশু!’ স্বীকার করতে এতটুকু সঙ্কোচ নেই। অলিম্পিককে ঘিরে যে প্রত্যাশা মনে ওড়াউড়ি করছিল, ১ আগস্ট রিও ডি জেনেইরোতে পা রাখার পর তা আর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নিজের ব্যর্থতার কথা বিস্তারিত না বলাই ভাল। পেশাদার স্বত্ত্বা বারবারই হোঁচট খেয়েছে অলিম্পিকের প্রায় প্রতিটা ইভেন্টে। প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে, আরো ভাল কিছু করার ছিল, উচিতও ছিল; কিন্তু হয়নি।তবে এ নিয়ে কোন অনুশোচনা নেই, সবাই তো আর সবকিছু পারেও না। বরং আত্মতৃপ্তি আছে অলিম্পিক অভিষেকের। আয়তনে, সংখ্যায় বিশ্বের আর যে কোন আসরের চেয়ে বড় অলিম্পিক। এ আসরেও ফার্স্ট, সেকেন্ড কিংবা থার্ড হওয়ার ব্যাপার আছে। উসাইন বোল্টকে তো আর এমনি এমনি ‘অমরত্ব’ দেয়নি সবাই! কিন্তু অলিম্পিকের বিশেষত্ব হলো, সবার পেছনে পৌঁছে যাওয়া অ্যাথলেটের জন্যও সন্মান বরাদ্দ থাকে। এখানে ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ বলে একটি বন্দোবস্ত আছে, যার সুবাদে হাজার মাইল পিছিয়ে থাকা প্রতিযোগিও খেলার সুযোগ পান। এবার তো নজিরবিহীন একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)।পরিস্থিতির শিকার হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত শরনার্থীদেরও একটি দল অংশ নিয়েছে এবার। সবমিলিয়ে ২০৭টা দলের প্রায় ১১ হাজার অ্যাথলেট। কর্মকর্তা, সাংবাদিক আর স্বেচ্ছাসেবক মিলিয়ে অলিম্পিকের অন্দরমহলেই ভীড়টা ছিল ৭০ হাজারেরও বেশি। সঙ্গে ৫লাখ অলিম্পিক পর্যটক ধরলে রিও’র জনসংখ্যা ১৬ দিনের আসর চলাকালে বেড়ে গিয়েছিল প্রায় ৬ লাখ।সংখ্যার চেয়েও বড় ব্যাপার সারা বিশ্বের সংস্কৃতি এক স্রোতে মিলেমিশে যাওয়া। টিভিতে নিশ্চয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখেছেন অনেকে। এতদিন মনে হতো অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মার্চপাস্টই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একমাত্র বিরক্তিকর অংশ; কিন্তু একটু মনোযোগ দিলেই দেখবেন কেমন টানছে উদ্বোধনী দিনের দীর্ঘতম এ অংশটি। মনে হচ্ছিল অলিম্পিক না দেখলে কত দেশের নামই অজানা থেকে যেত! সে সব দেশের পতাকার রং, পোশাকের ডিজাইন; গায়ের রং, চেহারার বৈশিষ্ট্য- এক ঘন্টার মার্চপাস্টে পুরো বিশ্বকে একবার দেখে নেয়া যায়।এই দেখার যেন কোন শেষ নেই। প্রতিটি ভেন্যুতে মাঠে এবং গ্যালারিতে সারা বিশ্ব হাজির। স্বাগতিক বলে ব্রাজিলিয়ানদের দাপটটা স্বভাবতই বেশি ছিল; কিন্তু কমবেশি সমর্থক ছিল অংশগ্রহণকারী সব দলেরই। মাঠের ইভেন্ট শেষে রেস্তোরাঁ, হাট-বাজার, ফুটপাথে পাশাপাশি পুরো বিশ্ব। কোপাকাবানায় হৈ-হল্লা চলেছে অহরাত্রি। সৈকতের পেভমেন্ট ধরে সারি সারি রেস্টুরেন্ট। সেগুলোর সামনে দিয়ে হয়ত আনন্দ মিছিল যাচ্ছে কোন দেশের পদক জয়ের, তা দেখে রেস্টুরেন্টের ভীনদেশীরা অভিনন্দন জানাচ্ছেন হাততালি দিয়ে। কেউ কেউ আবার যোগও দিচ্ছেন সে মিছিলে। রিও’র লাপা হলো পার্টি এনিমেলদের আখড়া। শনিবার রাতে লাপার মূল সড়ক গাড়ি চলাচলের জন্য বন্ধ হয়ে যায় রাত ১০টায়। পার্টিবাজদের সুবিধার কথা ভেবে। তো, সেখানেও পুরো বিশ্ব একত্রিত। কুশল বিনিময়ের শুরুতেই সবাই জেনে নিচ্ছেন কে কোন দেশের অধিবাসী। ‘তোমার দেশ কটা পদক জিতল’- জাতীয় প্রশ্ন করে কেউ কাউকে বিব্রত করতে চায় না। বিব্রতবোধও কেউ করে না। এই যেমন উসাইন বোল্টের সঙ্গে বিজয়ের মঞ্চে দাঁড়াতে পেরেই আপ্লুত কানাডার স্প্রিন্টার আন্দ্রে ডি গ্রাস। তেমনি নিজের ব্যাটনটা এলেইন টমসনের দখলে যেতে দেখেও এতটুকু হাসি মোছেনি শেলি-অ্যান ফ্রেজারের মুখ থেকে। মাঠে তারা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী; কিন্তু রেস শেষ তো সবাই পরম বন্ধু। দেখে মনে হবে না একটি অলিম্পিকে অংশ নেয়ার জন্য জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।অলিম্পিকের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক সম্ভবত এটাই। এখানে লড়াই হবে। লড়াইয়ে কেউ জেতে, কেউ হারবেই; কিন্তু জীবন থেমে থাকবে না। লড়াই শেষে তাই সবাই সবার বন্ধু। বিজয়ীর প্রশংসা অকাতরে করেন বিজিত। আবার বিজিতকে পিঠ চাপড়ে দিতে ভোলেন না বিজয়ী। দর্শকও সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রতিযোগিকে উৎসাহ দেয় প্রবল সমর্থনে। একজন অলিম্পিয়ানের এমন ঢালাও মর্যাদা আর কোনো খেলায় আছে বলে জানা নেই। তাই সবার পেছনে থেকে অলিম্পিক শেষ করাতেও কোন অনুশোচনা নেই। বরং গর্বই বেশি, অলিম্পিকের একটা মালা অন্তত মিলল!জাগো চ্যাম্পিয়ন ১০ম সংখ্যা পুরো পড়তে ক্লিক করুন এখানে...আইএইচএস/আরআইপি

Advertisement