মতামত

৫৭ ধারাই ১৯ ধারা

গত সোমবার মন্ত্রিসভা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে। এ আইনটিতে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত মীমাংসিত কোনো বিষয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলে বা এ ধরনের অপপ্রচারে মদদ দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এর পাশাপাশি এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।এই আইনটি পাস করা হলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাও বাতিল হয়ে যাবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। সরকার বলছে প্রস্তাবিত এই আইনে বিদ্যমান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা থাকছে না। ওই ধারাটি বাতিল করে নতুন আইনের ১৯ ধারায় মানহানি, মিথ্যা বা অশ্লীল ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে।২০০৬ সালে বিএনপির আমলে প্রণীত তথ্য প্রযুক্তি আইনটির ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ১০ বছর কারাদণ্ড ও ১ কোটি টাকা জরিমানা। আওয়ামী লীগের আমলে প্রথমে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এসব ধারার অপরাধের শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বাধিক ১৪ বছর ও কমপক্ষে ৭ বছর করা হয়।দেখা যাচ্ছে ৫৭ ধারার পরিবর্তে এখন ১৯ ধারা বলে একটি ধারার জন্ম নিচ্ছে। ৫৭ তে শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ১৪ বছর আর ১৯ ধারায় সর্বোচ্চ ২ বছর। অর্থাৎ ধারার জায়গায় ধারাই থাকছে শাস্তির মেয়াদ শুধু কমছে। এতে আইনটিতে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েই গেল। কারণ সরকারের প্রস্তাবে মনে হচ্ছে নতুন নামে নতুন আঙ্গিকে ভিন্ন চেহারায় ৫৭ ধারা ফিরে আসছে। ওদিকে প্রস্তাবিত আইনে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত মীমাংসিত কোনো বিষয়ের সাথে যুক্ত করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলেই বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ আসবে। তবে ৭২ পরবর্তী বঙ্গবন্ধু ও ৭২ পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধু নিয়ে কেউ গবেষণা করলে সেখানে প্রসঙ্গক্রমে কোন না কোন সমালোচনা আসতে পারে। আশঙ্কাটা হলো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলে বা এ ধরনের অপপ্রচারে মদদ দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর পাশাপাশি এক কোটি টাকা জরিমানাও হতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কোন রকমের বিতর্ক আমরা প্রত্যাশা করি না। তিনি জাতির জনক, বাংলাদেশের স্থপতি এ নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু তার সম্পর্কে কেউ সমালোচনা করলে সেটা কি অপপ্রচারের পর্যায়ে পড়বে? প্রস্তাবিত এই আইনে অপপ্রচার শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইন প্রণেতারা নিশ্চয়ই এই শব্দটির ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্ট করবেন। কারণ কোন একজন যেটা প্রচার মনে করবে অন্যএকজন সেটাকে অপ মনে করতেই পারে।যেমন, বঙ্গবন্ধুক সম্পর্কে অতি সরলীকরণ করে বলা হয় তিনি মহান নেতা হতে পারেন কিন্তু ভালো শাসক ছিলেন না। আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো এটা অপপ্রচার। কিন্তু আরেকজনের বিশ্লেষণতো হতেই পারে তিনি ভালো প্রশাসক নন। কারণ দয়ালু ব্যক্তিরা ভালো শাসক হতে পারেন না। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা কোন মাপকাঠিতে বিচার হবে? প্রস্তাবিত আইনে আরো একটা বিষয় পরিস্কার করা উচিত। খসড়ায় বলা হয়েছে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে অপপ্রচার চালালে, তার মানে কি অন্য কোন মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো যাবে? অথবা কেউ জনসভায় এমন কথা বললেন সেটা অপপ্রচারেরই শামিল আর সেটা সরাসরি কোন টেলিভিশন প্রচার করলে তাতে কি ওই টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে? প্রসঙ্গত: খসড়া আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার প্রধান থাকবেন একজন মহাপরিচালক, যিনি জরুরি পরিস্থিতিতে যেকোনো সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন। এই মহাপরিচালকের হাতে এত মহা ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি আইন প্রণেতারা আরো বেশি করে ভাববেন আশা করি। আরো একটি বিষয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে সেটি হল এরই মধ্যে যেসব অপপ্রচার করা হয়েছে সেগুলোর ইন্টারনেট ভার্সন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এতোদিন যে সমালোচনা বা অপপ্রচার নানা মাধ্যমে করা হয়েছে যেগুলো এরইমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর ইন্টারনেট ভার্সনও কি অপরাধের আওতায় আসবে। অর্থাৎ যেসমস্ত লেখক বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করেছেন যা প্রস্তাবিত আইনের আওতায় অপপ্রচার হতে পারে সেই লেখা বা আর্টিক্যাল কি ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে নিতে হবে? বর্তমান বিশ্বে সাইবার নিরাপত্তা বা ডিজিটাল নিরাপত্তা যে নামেই ডাকা হোক না কেন নানা কারণে এরকম আইনের দরকার আছে। কিন্তু জাতির জনক নিয়ে অপপ্রচার চালালে তার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড একটু বেশিই মনে হবে। কারণ রাজনৈতিক ইস্যুতে বিতর্ক হবে কিস্তু কুৎসা রটনা করা যাবে না। আবার কেউ কুৎসা রটালে তার শাস্তিও হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই সারা জীবনের জন্য জেল খাটা হতে পারে না। এক্ষেত্রে বড়মাপের আর্থিক দণ্ডই উত্তম অপশন হতে পারে। লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজএইচআর/পিআর

Advertisement