জাতীয়

আবারো নাশকতাকারীদের টার্গেট পুলিশ

আবারও নাশকতাকারীদের টার্গেটে পড়েছেন মাঠপর্যায়ের দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যরা। দুর্বৃত্তদের হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না এলিট ফোর্স র‌্যাব এবং সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবিও। কোথাও চোরাগোপ্তা, আবার কোথাও প্রকাশ্যেই পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।টানা অবরোধে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের মনোবল ভেঙে দিলেই সরকারের টনক নড়বে। এজন্য মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বশীল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপর টার্গেট করে হামলা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান চালিয়ে এর সত্যতাও পেয়েছেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ মহলকে জানিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।সূত্রে জানা গেছে, যে চক্রটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলার পরিকল্পনা করছে গোয়েন্দা সংস্থা তাদেরকে সনাক্ত করেছে।গত বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংস ঘটনায় ২৯ জন পুলিশ সদস্য নিহত এবং কয়েক শ’ আহত হন।গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দাবি, গত বছর ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে যে মহলটি র‌্যাব-পুলিশকে টার্গেট করে হামলা চালিয়েছিল, সেই মহলটি আবারো একই কায়দায় চলমান অবরোধে হামলা চালাচ্ছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকালের অবরোধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই সপ্তাহে কেবল পুলিশকে টার্গেট করে অর্ধশতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে।এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট জেলা ও বিভাগীয় পুলিশ প্রশাসন জনসাধারণের নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। নিজেদের নিরাপত্তা ও জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েনের দাবি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন।পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির ওপর হামলার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যদের সতর্কভাবে ডিউটি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত (১৭ জানুয়ারি) শনিবার রাতে রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে পুলিশ বহনকারী একটি বাসে বোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় এসআই আবুল কালাম আজাদ, কনস্টেবল শামীম, মোর্শেদ, সিপন ও বদিয়ার নামে পাঁচ পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়।গত ১২ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেত বাজার এলাকায় পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। বিস্ফোরণে খিলক্ষেত থানার এসআই কামাল, আনসার সদস্য হেলাল খান, মুনসুর আলী ও রিকশাচালক আবদুল লতিফ আহত হন।৫ জানুয়ারি রাজধানীর কদমতলীতে দুর্বৃত্তরা পুলিশের রিকুইজিশন করা একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে এক আনসার সদস্য দগ্ধ হন।একই দিন ফকিরাপুলে পুলিশের টহল গাড়ীতে হামলা চালায় ছাত্রদল কর্মীরা। এসময় তারা পুলিশের একটি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেয়। আহত হয় দুই পুলিশ সদস্য।এর আগে গত ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে বাংলামটরে পুলিশের রিক্যুইজিশন করা গাড়িতে পেট্রোলবোমা হামলায় সাইদুর রহমান নামে ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল নিহত এবং দুই জন গুরুতর দগ্ধ হন।রাজধানীর বাইরে পুলিশের উপর যত হামলা:রাজধানীর বাইরে সরাসরি পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল হামলা, পুলিশের যানবাহনে আগুনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ৬ জানুয়ারি রাজশাহী নগরীর সপুরা এলাকায় আলিফ লাম মিম ইটভাটার সামনে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পুলিশকে বেধড়ক পেটায় শিবিরের কর্মীরা। এতে গুরুতর আহত হন ৫ পুলিশ সদস্য।একইভাবে গত ১৪ জানুয়ারি রোববারও রাজশাহী কলেজের সামনে র‌্যাবের গাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল হামলা চালিয়েছে শিবির।১২ জানুয়ারি রাতে রাজশাহীর পুঠিয়ার শিবপুর এলাকায় পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল হামলা চালানো হয়।১৪ জানুয়ারি বিকালে রাজশাহী নগরীর সোনাদীঘির মোড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত ও গাড়ির আংশিক পুড়ে যায়।এর আগে রাজশাহীতে গত ৪ বছরে ৬ বার পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশকে পিটিয়েছেও তারা।অপরদিকে অবরোধের তৃতীয় দিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ট্রাকে আগুন ও পুলিশের উপর হামলা চালায় অবরোধকারীরা।যশোরেও বাস ভাঙচুর, পুলিশের কাজে বাধা দান ও হামলা, বাগেরহাটে পুলিশের উপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ।অপরদিকে দিকে হবিগঞ্জেও পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।গত ১৮ জানুয়ারি কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে লিবার্টি চত্বরে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। এতে কোতয়ালী থানার সেকেন্ড অফিসার সালাউদ্দিন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাসির, কনস্টেবল হাসান ও হাবিলদার রুবেলসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন।১০ জানুয়ারি সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে বিজিবির প্রহরায় ছেড়ে আসা একটি পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে হাতবোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে এক বিজিবি সদস্যসহ তিনজন আহত হন।গত ৬ জানুয়ারি রাত ১২টায় লক্ষ্মীপুরের লতিফপুরে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এ হামলায় এএসআই জাহাঙ্গীর আলম ও কনস্টেবল আবু সিদ্দিক গুরুতর আহত হন।৭ জানুয়ারি সকালে বগুড়া মহাসড়কের ছিলিমপুরে পুলিশকে লক্ষ্য করে শিবিরকর্মীরা বোমা নিক্ষেপ করে। পুলিশের সাথে পাল্টা গোলাগুলির ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক।এছাড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, ফেনী, চট্টগ্রামও সিরাজগঞ্জেও পুলিশের উপর হামলার খবর জানা গেছে।এসব ঘটনায় পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, দায়েরকৃত মামলায় জড়িতরা শাস্তি না পাওয়ায় হামলা বাড়ছে।এ ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনের কল কেটে দিয়ে এসএমএস করে জানান, পরে কথা বলবেন। তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।তবে পুলিশের এক উধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ বাহিনী মানুষের জানমাল রক্ষায় একচুলও ছাড় দিবে না। জীবন বাজি রেখে দেশে শান্তি বজায় রাখছে পুলিশ বাহিনী। ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ছবি দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। শিগগিরিই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল জিয়া বলেন, র‌্যাবই একমাত্র ফোর্স যে গত বছর থেকে এ বছর পর্যন্ত কোথায়ও র‌্যাবের ওপর হামলা হয়নি। তবে র‌্যাবের ওপর হামলা চালানো হলে র‌্যাবও পাল্টা হামলা চালাবে। একটা গুলির জবাবে প্রয়োজনে ১০টা গুলি ছুড়বে র‌্যাব। তবুও কোথাও সন্ত্রাসী, নাশকতাকারীদের আস্তানা রাখা হবে না। হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেই দুইদিনে কোথাও পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনা ঘটেনি বলেও দাবি করেন তিনি।তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সহিংসতা বন্ধ করতে গেলে এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলবে।রংপুরের মিঠাপুকুরে গিয়ে পুলিশের আইজিপি ও র‌্যাবের মহাপরিচালকের অবরোধ আন্দোলন প্রতিরোধের বিষয়ে দেয়া রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে পুলিশ-র‌্যাবের ওপর আন্দোলনকারীদের আক্রোশ বেড়েছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।এ প্রসঙ্গে আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক বলেন, মানুষ মাত্রই নাশকতা আর সহিংসতা চায় না। পুলিশকে টার্গেট করে দুর্বৃত্তদের হামলা থেকে রেহাই পেতে উত্তরণের পথ বের করা অত্যন্ত জরুরি। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বর্তমান সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে।তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে দমননীতির মাধ্যমে সহিংসতা বন্ধ করার চেষ্টা করলে ফল আরও সহিংস হয়।জেইউ/এআরএস

Advertisement