ফারহিয়া। তার বাবাকে হারিয়েছিলেন যখন তিনি শিশু। প্রায় ৪০ বছর বাবাকে দেখেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে হারানো বাবাকে ফিরে পেলেন তিন যুগেরও বেশি সময় পর। ‘অভিনন্দন! আমরা আপনার বাবাকে খুঁজে পেয়েছি’! ইনবক্সে এমনই একটি মেইল পেয়েছিলেন ফারহিয়া। তিনি বলেন, প্রথমে এই সংবাদটি পেয়ে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এটি ছিল স্বপ্ন, সত্যি হয়েছে। কিন্তু আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম, একদিন এই মুহূর্তটি আসবে। সেই ছোটবেলা থেকে ফারহিয়া তার মায়ের কাছে প্রতিনিয়ত বাবার বিষয়ে জানতে চাইতেন, কেমন ছিলেন তিনি। ফারহিয়া বলেন, তিনি (মা) আমাকে আয়নার দিকে তাকাতে বলতেন। ফারহিয়ার মা তাকে বলতেন, তুমি তার (বাবার) মতো কথা বলো, তার মতোই চলাফেরা করো, এমনকি তার মতো করেই যুক্তি দাও। ৩৯ বছর বয়সী ফারহিয়ার জন্ম রাশিয়ার লেলিনগ্রাদে; ১৯৭৬ সালে। সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ান এক মা ও সোমালিয়ান বাবার কাছে বসবাস করছেন। সোমালিয়ার তরুণ কর্মকর্তা সিদ আহমেদ শরিফ সোভিয়েত ইউনিয়নের আমন্ত্রণে পড়াশোনা করতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ফারহিয়ার মাকে বিয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন সিদ।কিন্তু এক বছর পর ফারহিয়ার জন্ম হয়; এর মাঝেই প্রতিবেশী ইথিওপিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সোমালিয়া। ইথিওপিয়ার পক্ষ নেয় ক্রেমলিন। দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করে সোমালিয়া। ফারহিয়ার বাবাসহ সোভিয়েতে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ফারহিয়া বলেন, আমার মা এবং আমি পশ্চিম সার্বিয়ায় দাদির বাড়িতে বেড়াতে যাই; সেই সময় প্রথম সোমালিয়া যুদ্ধের বিষয়ে জানতে পারে রেডিওতে। আমার মায়ের কাছ থেকে শর্তহীন ভালোবাসা পেয়েছি। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল বাবা। তিনি বলেন, বাবাকে খুঁজে পাওয়ার আকাঙক্ষা ছিল সব সময়। আমার বয়স যখন ১২; তখন আমার মাথায় জেঁকে বসে, বাবাকে খুঁজে পেতে আমাকে কিছু করতেই হবে।সময়ের চাকায় পরিবর্তন হয় রাজনৈতিক আবহ। মিখাইল গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত নীতি সে সময় প্রক্রিয়াধীন; তার বাবার কাছে লেখার জন্য কোনো উপায় নেই। তিনি বাবার ঠিকানায় চিঠি পাঠাতেন; কিন্তু সেই চিঠি ফেরত অাসতো। জানতেনও না সেই চিঠি সোমালিয়ায় তার বাবার কাছে পৌঁছাতো কিনা। বাবাকে খুঁজে পেতে রেডক্রসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ফারহিয়া। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। রাশিয়ার অন্য শিশুরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নিখোঁজ তাদের বাবাকে ফিরে পান। সেসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও রাজনীতিক সুসম্পর্ক ছিল, ব্যতিক্রম ছিল সোমালিয়া। কেননা সোমালিয়ার সঙ্গে আফ্রিকার অনেক দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল সীমিত। একপর্যায়ে বাবাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন ফারহিয়া। এবার অন্য পন্থা অবলম্বনের চিন্তা করেন তিনি। কয়েক বছর ধরে নতুন চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। কিন্তু বার বার সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হতে থাকে। সোমালিয়ায় ১৯৯১ সালে যখন ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে ফারহিয়া বড় ধরনের ধাক্কা খান সেই সময়। দুই দশক ধরে চলে গৃহযুদ্ধ; এক সময় বন্ধ হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ, নতুন করে আশা জাগে ফারহিয়ার চোখে; যখন দেশটিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সক্রিয় হতে থাকে।রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিকনটাক্ট`র (Vkontakte) মাধ্যমে জানতে পান, এক নারী হারানো বাবাদের খুঁজে পেতে সহায়তা করছেন। ফারহিয়া বলেন, আমি তার কাছে চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু আমার বাবা যদি সোমালিয়ায় থাকেন তাহলে তিনি সহায়তা করতে পারবেন না। এরপর ইন্সটাগ্রামে সোমালিয়ার ছবি ব্যবহার শুরু করেন ফারহিয়া। সোমালিয়ার নাগরিক ডিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। গত ১৬ মার্চ ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে তার বাবাকে ফিরে পেতে সহায়তার আহ্বান জানান। সেখানেই তুলে ধরেন কীভাবে তার বাবাকে হারিয়েছেন তিনি। এরপর কমেন্ট, শেয়ারে ভেসে যায় তার স্ট্যাটাস। নরওয়ের এক ব্যক্তি সেই পোস্টে কমেন্টে বলেন, এইতো আমাদের বোন ফারহিয়া। অসলোয় বসবাসকারী ফারহিয়ার এক ভাই ওই কমেন্ট করেন। পরে ফারহিয়া ও পরিবারের অন্য সদস্যরা ছুটে যান নরওয়েতে। এরপর দেখা মেলে ফারহিয়ার বাবার। এখন শরিফের সঙ্গে নিয়মিত স্কাইপিতে কথা বলেন ফারহিয়া ও তার মা। পিটার্সবার্গে যাওয়ারও পরিকল্পনা করেছেন শরিফ। ফারহিয়া তার বাবাকে এখন জানাতে চান তার গত চার দশকের বাবাবিহীন জীবনের কাহিনী। বিবিসি অবলম্বনে।এসআইএস/আরআইপি
Advertisement