১৭ই জুলাই, ২০১৬, দুপুর। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আমরা যখন পৌঁছুলাম তখন বিমান বন্দর আমার স্মরণকালে দেখা সবচেয়ে ফাঁকা ছিল। আমাদের প্লেন ল্যান্ড করতে দেরি করেনি। তবুও ইমিগ্রেশনে লাইনে মাত্র ৪/৫ জন যাত্রী। দেখে স্বস্তিই লাগছিল যে ওভার নাইট জার্নির পর দেশে পা রেখে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে না। দ্রুত ইমিগ্রেশনের ছাড়পত্র পেয়ে একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে বাবাকে নিশ্চিত করতে ফোন বের করছি। পেছনে আমার ছেলে ইমিগ্রেশনে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে ; ফিরে দেখি তাকে বিভিন্ন ভাবে প্রশ্ন করা হচ্ছে। তার চশমা খুলে পেছনে গিয়ে হেঁটে এসে ফের সামনে এসে কর্মকর্তার কম্পিউটারের কাছে নিয়ে এসে মনিটরে কিছু ক্লিপ দেখানো হচ্ছে। আমার বুক ধক্ করে উঠলো। আমার সবসময় আয়াতুল কুরসী আওড়ানোর অভ্যাস। ব্যস্ত রাস্তায় কেউ আমার ঠোঁটের দিকে তাকালেই দেখতে পান আমি বিড় বিড় করছি। জানিনা অন্যকিছু ভাবে কিনা। এখন সেই সাথে বিপদ মুক্তির দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলাম। একমাত্র ভরসা, আমার ছেলে মাশাল্লাহ্ মাথা ঠাণ্ডা। আশা করি সে ঘাবড়ে গিয়ে ওলট পালট কিছু জবাব দেবেনা বা ভয়ে অপ্রকৃতিস্থ কিছু করে বসবে না । এছাড়া সে খুব সুশৃঙ্খল, নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে কোন প্রশ্নের সরল উত্তরটা সোজাসুজি সবিনয়ে সহাস্যে দিতে জানে। আমার হার্টবিট বিপদজনকভাবে বেড়ে যাবার আগেই ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র দিল। জানতে চাইলাম কি কি জিজ্ঞেস করেছে, ভিডিওতে কি দেখিয়েছে। যা জানলাম তাতে বুঝে গেলাম ও খুব সহজ এক সমীকরণে পড়ে গিয়েছিল।ওর ঠিক সেদিন, জুলাই ১৭ তেই ১৮ বছর হয়েছিল। ও জন্মসূত্রে বাংলাদেশি, কিন্তু আমরা জাপানে থাকায় সে স্বাভাবিক নিয়মেই অনেক বছর পড়াশোনা করছে বিদেশে, হিসেবমতে দীর্ঘদিন প্রবাসী। এর মাঝে একা এবং সপরিবারে কয়েকবার দেশে এসেছে। ২০১৪ তে একা একা এসেও দেড় মাস থেকে গেছে। সম্ভাব্য সমীকরণের অনেক প্রয়োজনীয় গাণিতিক উপাত্ত মিলে যায়। আমরা হতবিহ্বল হয়েছি, বিরক্ত হইনি। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশের ভালর জন্য সামান্য বিড়ম্বনায় আমরা ধৈর্য্যহারা হইনা। তবে, এখন যারা দেশে যারা আছ্নে তাদের মতন অস্বাভাবিক যাপিত জীবনের বাসিন্দা হলে কি ভাবতাম জানিনা। ফেরার পথে পুরো রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ জোরদার দেখলাম। আতঙ্ক ১লা জুলাই থেকে মনে সেঁটেই ছিল। অফিসের অনেক নিষেধাজ্ঞা, সতর্কতা, সাবধানতা লাগেজের চেয়েও অনেক বেশি ভারী হয়ে জাপান থেকে আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী ছিল। ছেলে সারাপথ গল্পে বারবার দেশের নাম উচ্চারণ করে, আর আমি সতর্ক করি। প্রশ্ন উঠতে পারে এমন জঙ্গি হত্যাকাণ্ড কি শুধু আমাদের দেশেই ঘটেছে? না, সারা বিশ্বই এতে তোলপাড়, আশাহত। সমস্যা আমাদের আত্মবিশ্বাসে, পারস্পরিক আস্থায়; যার উৎস রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ। আসার আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা হয়ে গিয়েছিল দোকান পাট, রেস্তোরাঁয় বিশেষ সতর্কতা দেয়া আছে। ভীড় এড়িয়ে চলতে হবে। আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনও বার বার সতর্ক করে যাচ্ছে। খুব কঠিন শর্ত ছিল আমাদের জন্য। কারণ, এসেছি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে এবং জাপানে এই উপমহাদেশীয় কোন দোকান পাট নেই, কারণ জাপান ইমিগ্রেন্ট বান্ধব দেশ না। তবুও শপিংএ যাইনি। দেশি মশলা ছাড়া আর কিছুই তেমন জাপানে পাওয়া যায় না । দেশি খাবারের জন্য বুভুক্ষু থাকি। তবুও দেশে এসে কোন রেস্তোরাঁয় যাইনি। বিয়ের অনুষ্ঠানের খাবার অনেক অতৃপ্তি মিটিয়ে দিয়েছে। বাইরে থেকে এলেই স্টমাক আপসেট হয়, খুব বেছে খেয়েও এর থেকে পরিত্রাণ পাইনা। কিন্তু অভিযোগ করিনা, কারণ সবকিছুরই কিছু মূল্য চুকাতে হয়। অনুষ্ঠানে যাওয়া আসায় রাত হয়, গাড়ী থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। আশ্বস্তই হই। সম্ভাব্য উপায়ে বিপদ এড়ানোর চেষ্টা তো হচ্ছে। সতর্ক প্রহরা তো আছে! এর ভেতরে নিজস্ব সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে বরিশাল যেতে হলো। বরিশাল কিন্টারগার্ডেন ফোরামের সারাদিন ব্যাপী আয়োজনে প্রধান অতিথি হয়ে। জীবনে প্রথম লঞ্চযাত্রা, একা এবং রাতের লঞ্চ। বরিশালে গিয়ে বন্যা দেখলাম। রাস্তা ভেঙ্গে গেছে। বিকল্প পথে ট্রলার, বাশের সাঁকো, কলা গাছের সাঁকো, নসীমন-সব চড়ার প্রথমবারের অভিজ্ঞতা হলো। এর মধ্যে আমার নিরাপত্তার উপর্যুপরি ফোন চলছে। দুপুরে শিক্ষাসংক্রান্ত ক্যাম্পেইন প্রোগ্রামে ডিবি পুলিশসহ প্রায় ১০ জনের বাহিনী যাবে। ৩টার পর কেউ হলে প্রবেশ করতে পারবে না। পুরো অনুষ্ঠানের বক্তব্য খুব মনোযোগ দিয়ে তারা শুনলেন। উস্কানিমূলক কিছু বলা হচ্ছে কিনা তার যাচাই হয়তো। আর এতো অধিক নিরাপত্তার কারণ- আমি ভীনদেশি! বার বার আয়োজকেরা উল্লেখ করেছেন তিনি জাপান প্রবাসী বাঙালি। লাভ হয়নি। স্বস্তি পেয়েছি এই ভেবে যে ভীনদেশিদের নিরাপত্তার চেষ্টা তো সত্যিই সরকার নিয়েছেন। ফেরার দিন আবারো ইমিগ্রেশন। আবারো আমার ছেলের একদফা ইন্টারোগেশন। আমরা এবারেও বিরক্ত হইনি। প্লেনের যখন চাকা ঘুরতে আরম্ভ করে, জানালা দিয়ে দেশটা ঝাপসা হতে থাকে সেই মুহূর্তটা সবসময়েই আমার সবচেয়ে কষ্টকর। শেকড় উপড়ানোর তীব্র বোবা হাহাকার। মনে দ্বিধা কাজ করছিল, আমার ছেলেটা কি ভাবছে তার বিড়ম্বনাগুলি নিয়ে। আমার মতই জানালায় চোখ রেখেই ও বললো, “ মা আমি ইউনিভার্সিটি থেকে সামার ভেকেশনে জাপান যাব না। জাপানে তো শুধু তোমরা আছ। আমার গোটা পরিবার, আমার সব কিছু তো দেশে আছে। আমি এখানেই আসবো। তোমরা জাপান থেকে এখানে চলে আসবে। আমরা এখানেই দেখা করবো। জাপানে যাওয়া, আর যে দেশে পড়ছি, ভেকেশনে সেদেশেই ঘুরতে থেকে যাওয়া তো একই। সেটা তো সামার ভেকেশনে কাটাবার মতন এতো স্পেশাল কোন প্লেজার ট্রীপ না।” আমি অনেক্ষণ ওকে দেখলাম। দেশের স্মৃতি ওর সামান্য। তবুও বিশ্বের এতো দেশ থাকতে আমাদের দেশটাতেই তার গ্রীষ্মকালীন ছুটির আনন্দ ভ্রমণের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গা মনে হয়েছে। জান বাজি নিয়ে আসা এবারের এই অভিজ্ঞতার পরেও! আমার বিশ্বাস, ওর মতন বয়সী সব ছেলেদের মনেই এই ভালবাসাটাই সুপ্ত আছে। প্রকাশের যে ফারাকটা হচ্ছে তা হলো, এই বয়সটা এমন এক বয়স যখন সুস্থ বিনোদন, সুকুমার কলা, শারীরিক ক্রীড়াচর্চাহীন অসুস্থ প্রজন্মের মস্তিষ্কের এসব শূন্যস্থান পূরণ করছে অসুস্থ অশুভ সংস্কৃতি, অন্ধত্ববাদের চর্চা। যে বয়সে তারুণ্যের টগবগে রক্ত গরম উত্তেজনায় সব অনিয়ম, অন্যায়, অসমতা ভেঙে চূড়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবার উল্লাসে কাঁপতে ইচ্ছে করে সেই বয়সের সেই নির্দোষ নির্ভেজাল উদ্দীপনাকেই অপব্যবহার করে ঝানু নীল নকশার কারীগরেরা বিপথগামী কিছু মরিয়া যুবক তৈরি করে তাদের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে। আজকের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের মুখোশে ধর্ম আর ধর্মনিরপেক্ষতার অপব্যবহার সুপ্রাচীন হীন পন্থারই আধুনিক রূপ। সেদিন যেমন সমাজতন্ত্র আর এর বাতিলকরণের সোপানতলে লাখ প্রাণ ঝরে গিয়েছিল, আজো তেমনি পবিত্র ধর্মের ভ্রান্ত মুখোশে হচ্ছে, হবে। যারা এর থেকে রুটি, মাখন, ক্রীমটুকু পাচ্ছেন তারা এই লড়াইয়ে প্রণোদনা দিয়েই যাবেন, জিইয়েই রাখবেন। কারণ, অনেক বেশিই ধরা ছোঁয়ার বাইরের মানুষ, বলির পাঠা না। এই জটিল সমীকরণ যত দ্রুত বুঝতে শুরু করা যাবে ততই দেশকে, প্রজন্মকে রাহুমুক্ত করতে কিছুটা হলেও এগুনো যাবে। সক্রেটিস প্লেটোকে যেমন বলেছিলেন “ নিজের কাজটা সবচেয়ে ভালভাবে করাই সর্বত্তম দেশপ্রেম।” চীন-জাপানে এরা বিশ্বাস করে, রাজা রাজনীতি, রাজ্যশাসন দেখবে- সেটা তাঁর কাজ। জনগণের কাজ নিজ নিজ পেশায়। আগে অবাক হতাম, এখন ভাবি `সত্যিই তো`। ধার যাক, পুলিশ যদি সততার সাথে অপরাধী ধরেন, উকিল তা সঠিক যাচাই প্রমাণ করেন, বিচারক ন্যায় বিচার করেন তো জনতাকে কাজ ফেলে রাস্তায় নামতে হয় না। একটা দেশের যে কোনো কিছুতে রাস্তায় নেমে জান, মাল, সময়ের অপচয় করে আন্দোলন করতে হয় ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমজীবি সব শ্রেণির। সরকার জনগণমুখি তা প্রমাণে অক্ষম, জনগণও সরকারে আস্থা রাখতে অক্ষম। বিশ্বাস ছাড়া সংসার চলে না, গোটা দেশ কিভাবে চলবে? আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সততার সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস আর আত্মসন্মানেরও অভাব। সবাইকে জঙ্গি সন্দেহের তালিকায় তোলার আগে সন্তানগুলিকে কিছু আত্মবিশ্বাসের জায়গা দিন। কোনো সময়েই তাদের ভালবাসায়, ভক্তিতে কোন খাঁদ ছিল না। ঘরে ঘরে নতুন জঙ্গি যেন আর জন্ম না নেয়, পিতাকে যেন সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে অস্বীকার করতে না হয়; ওদের বিশ্বাসের, আত্মোৎসর্গের সঠিক লক্ষ্যটা নির্ধারণ করে দিন। লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপানএইচআর/এবিএস
Advertisement