মতামত

বেটার লেট দ্যান নেভার

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন কবে, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং অনলাইনে তাঁর অন্তত পাঁচটি জন্মদিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রতিটি দাবির পক্ষেই প্রামাণ্য দলিলও রয়েছে। ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ তারিখে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সরকারি বার্তা সংস্থা- বাসস থেকে পাঠানো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনীতে তাঁর জন্মদিন উল্লেখ করা হয় ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মার্কশিট অনুসারে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বিয়ের কাবিননামা অনুসারে তাঁর জন্মদিন ১৯৪৪ সালের ৯ আগস্ট। পাসপোর্ট অনুসারে তাঁর জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ আগস্ট। ২০০০ সালের ভোটারের তথ্য বিবরণী ফরমে খালেদা জিয়ার জন্মদিন উল্লেখ করা হয় ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট।১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর দৈনিক বাংলায় বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন হিসেবে ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট উল্লেখ করা হলেও সেই দৈনিক বাংলাতেই ১৯৯৩ সালে প্রথম তাঁর জন্মদিন ১৫ আগস্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সে বছর থেকেই ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন শুরু করেন তিনি। তবে প্রথমে তা ছিল নিছক ঘরোয়া। বিরোধী দলে যাওয়ার পর ১৯৯৬ সাল থেকে ১৫ আগস্ট ঘটা করে জন্মদিন উদযাপন শুরু করেন বেগম খালেদা জিয়া। তারপর প্রতিবছর ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে রীতিমত কেক কেটে আয়োজন করে পালিত হয়ে আসছে বেগম জিয়ার জন্মদিন।১৫ আগস্ট কেউ জন্ম নিতে পারবেন না, কারো জন্মদিন হতে পারবে না; এমন কোনো কথা নেই। অনেকেরই জন্মদিন নিয়ে নানা বিভ্রান্তি আছে। বিশেষ প্রকৃত জন্মদিনের সাথে সার্টিফিকেটের জন্মদিনের অমিল আছে, এমন লোকের সংখ্যা অগনন। যেমন আমার জন্ম হয়েছে ১৯৬৯ সালের ২৮ আগস্ট। কিন্তু কেন জানি না, সার্টিফিকেটে আমার জন্মদিন ১৩ মার্চ ১৯৬৮। জন্মদিন পালন করার মত কেউ নই আমি। তাই আমার একাধিক জন্মদিন নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, আমার তো নেইই। কিন্তু বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আপোষহীন নেত্রী, বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন, বড় আয়োজনে উদযাপিত হওয়ার মত উপলক্ষ্য। তাই তাঁর একটা তর্কমুক্ত নির্দিষ্ট জন্মদিন থাকা দরকার। প্রকৃত জন্মদিনের সাথে সার্টিফিকেটের জন্মদিনের ফারাক থাকাটা দোষের কিছু নয়। সবাই প্রকৃত জন্মদিন পালন করে। আর দালিলিক কাজে সার্টিফিকেটের জন্মদিন অনুসরণ করে। কিন্তু কারো পাঁচটি জন্মদিন থাকা সত্যিই বিভ্রান্তিকর। বেগম খালেদা জিয়ার চারটি জন্মদিনের পক্ষে দালিলিক প্রমাণ থাকলেও এখন যেটা পালিত হচ্ছে, সেই ১৫ আগস্টের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। আর যদি সত্যিই ১৫ আগস্টই তাঁর জন্মদিন হয়, তাহলে সেটা তার জন্মের প্রায় ৫০ বছর পর আবিস্কার হলো কেন? ১৯৯৩ সালের আগে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের কোনো তথ্য কি কারো কাছে আছে? এত বিভ্রান্তির পরও আমি ধরে নিচ্ছি, বাকি সবগুলো ভুয়া, ১৫ আগস্টই বেগম জিয়ার প্রকৃত জন্মদিন। কিন্তু জন্মদিন হলেই ১৫ আগস্ট সেটা ঘটা করে পালন করতে হবে কেন? একটি বড় দলের নেত্রী তাঁর জন্মদিন পালন করতে পারেন গরীব-দুঃখী মানুষকে খাইয়ে, এতিমদের সাথে সময় কাটিয়ে বা মিলাদ পড়িয়ে। বা চাইলে ১৫ আগস্টের একদিন আগে বা পরে তিনি তাঁর জন্মদিন পালন করতে পারেন।খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্ট উদযাপন যতটা না জন্মদিন, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। ৭৫এর ১৫ আগস্টের পর মুশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার সময়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য্যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনটি পালন শুরু হয়। ১৫ আগস্ট এখন জাতীয় শোক দিবস। জাতীয়ভাবে ১৫ আগস্ট পালন শুরুর পর ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়াও মহা আড়ম্বরে জন্মদিন উদযাপন শুরু করেন। এটা ঠিক বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। আর এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতেই শোক দিবসে খালেদা জিয়ার কেক কাটার আয়োজন। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে হবে কেন? যতদূর জানি, বেগম খালেদা জিয়ার সংসার টিকিয়ে রাখতে অবদান রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই বেগম জিয়ার তো বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কথা। আর বেগম খালেদা জিয়া এমনিতে অভিজাত, রুচিশীল, সেনসেবল ভদ্রমহিলা। তিনি কথা বলেন কম, মেপে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর মুখে আগে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো বাজে কথা শুনিনি। কিন্তু ইদানিং তিনিও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের সাথে সুর মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করে কথা বলছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কার বুদ্ধিতে হঠাৎ করে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন শুরু করলেন এবং নানামুখী সমালোচনার পরও সেটা চালিয়ে গেলেন, সেটা একটা বিস্ময়। বিএনপি নেতাদের অনেকের সাথে কথা বলে জেনেছি, আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানকে বারবার হেয় করে বক্তব্য রাখে বলেই তারা প্রতিশোধ হিসেবে আয়োজন করে বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন করে। এটা ঠিক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা অনেক অভিযোগ করেন। কিন্তু বিএনপির প্রতিশোধটা বড় নোংরা, নিষ্ঠুর।১৫ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন হতেও পারে, নাও হতে পারে। তবে বিএনপির আদর্শিক জন্মটা আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টেই। যদিও জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু বিএনপি এখন যে আদর্শ ধারণ করে, তার বীজ রোপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তেই। তাই হয়তো বিএনপি প্রতীকী অর্থে ১৫ আগস্ট পালন করে। তবে এটা না করলেই ভালো করবেন বেগম খালেদা জিয়া। এটা ঠিক জিয়াউর রহমান তাঁর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে আওয়ামী  লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছেন। নিজের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সমান দাবির তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা তাঁকে বঙ্গবন্ধুর সমান করতে উঠে পড়ে লাগে। তখন আওয়ামী লীগও পাল্টা জিয়াউর রহমানকে খাটো করতে মাঠে নামে। এই কাদা ছোঁড়াছুড়ি আমাদের রাজনীতিকে নোংরা করে ফেলে। রাজনীতিই খাটো হয়ে যায়।আমরা গলাবাজি করে, কাউকে ছোট বড় করতে পারবো না। ইতিহাসে যার যার অবস্থান নির্ধারিত। টুঙ্গীপাড়ার অজপাড়াগায় কবর দিয়ে, ২১ বছর নিষিদ্ধ রেখেও যেমন বঙ্গবন্ধুকে একটুও খাটো করা যায়নি, মুছে ফেলা যায়নি; তেমনি জিয়াউর রহমানকে বাই চান্স মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তানের চর বলেও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান মুছে ফেলা যাবে না। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, পেয়েছেন জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বোচ্চ খেতাব বীর উত্তম- এসব তো ঐতিহাসিক সত্য। বঙ্গবন্ধুই তাঁকে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান নিয়োগ দিয়েছিলেন।আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটি আলাদা দল, তাদের আলাদা আদর্শ, আলাদা নেতৃত্ব। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দল দুটি তাদের কর্মসূচি পালন করবে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাইবে, কোনঠাসা করতে চাইবে। কিন্তু তারও তো একটা নিয়ম, একটা ভদ্রোচিত অ্যাপ্রোচ থাকবে। আরেকজনকে খাটো করে কখনো নিজেকে বড় করা যায় না। যিনি বড়, তিনি আপন মহিমায় বড়।বহুবছর ধরেই নানা মহল থেকে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করার জন্য বেগম জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছিল। এমনকি বিএনপির ভেতরের শুভচিন্তার ধারক একটি মহলও এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে আসছিল। কিন্তু অনেকদিন ধরেই বিএনপি অশুভ চিন্তার খপ্পরে আছে। তবে এবার শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘দেশের চলমান সংকট, বন্যা পরিস্থিতি ও নেতা-কর্মীদের জেল-গুম-খুনসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়’ এবার বেগম জিয়া জন্মদিন পালন করছেন না। তবুও আমরা বুঝতে পারি, রাজনৈতিক কারণে বা চক্ষুলজ্জায় পুরো সত্যটা বলতে না পারলেও, এটা একটি শুভ বার্তা। আশা করি এই বার্তা, গোটা রাজনীতিতেই একটি শুভ আবহ ছড়িয়ে দেবে। দেরিতে হলেও বেগম খালেদা জিয়া একটি আত্মঘাতী ভুল শুধরে নিয়েছেন বলে তাকে ধন্যবাদ। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বেগম জিয়ার এই সিদ্ধান্তে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। শুভর জবাব শুভতেই হয়, গালির জবাব হয় গালিতে। বিএনপি একদিন নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে, বঙ্গবন্ধু কোনো দলের নয়, তিনি জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করলে জিয়াউর রহমানকে খাটোই করা হয়। সেদিন হয়তো তারা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাবে, ধানমন্ডি বা টুঙ্গীপাড়ায় ফুল দেবে। সেদিন নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের বীরত্বের স্বীকৃতি দেবে।রাজনীতিতে তেমন একটি শুভ ভোরের প্রত্যাশায় রইলাম আমরা।এইচআর/এমএস

Advertisement