মতামত

লেখকদের কাছে ‘বঙ্গবন্ধু’ একটি প্রভাব বিস্তারি শব্দ

বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘বঙ্গবন্ধু’ একটি প্রভাব বিস্তারি শব্দ। স্বাধীনতার আগে ভাষা-আন্দোলন এবং পরবর্তী সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের এমন কোনো বিষয় নেই যার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান ছিলেন। তিনি মানুষের চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেছে। ভারতীয় সাহিত্যে মাহাত্মা গান্ধী যেমন মানুষের কাছে লেখার উৎস ও প্রেরণায় পরিণত হয়েছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু অনেক লেখককে কেবল নয় দেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে উন্মোচিত হয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে কবির চেতনা-মননে অব্যক্ত বেদনার নির্ঝর নিঃসরণ হয়েছে। আবার বাংলা শিল্প-সাহিত্যে তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দুঃখ বাংলাদেশের সাহিত্যে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ নাম দিয়ে একটি সময়-পর্ব এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতীয় সাহিত্যে ‘গান্ধী-যুগ’ বলে একটি কালপর্ব নির্দিষ্ট হয়েছে। বিশেষত ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের দু’যুগের বেশি সময় ‘গান্ধী-যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত। কেন এই চিহ্নিতকরণ? কারণ এই মহামানবের জীবন ও কর্মের ব্যাপক প্রভাব। ভারতের এমন কোনো ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকর্ম নেই যেখানে গান্ধীজি নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যে অপ্রতুল হলেও এই স্বাধীনতার মহানায়কের জীবন ও কর্ম আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পটভূমি বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিককে আন্দোলিত করেছে।  মহানায়কের কথা, কাজ, শখ, বাগ্মীতা, বক্তব্য, তাঁর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুরই দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। বাগ্মীতায় জনগণকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্য সামাজিক মানুষের হৃদয়ে প্রবেশে তাঁর কষ্ট করতে হয়নি। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজ-সরল মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; তাতে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। গান্ধীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে প্রভাব জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, চেতনাকে করেছিল পরিশুদ্ধ, ধারণা দিয়েছিল পাল্টে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্য-চলচ্চিত্র-কবিতার মুখ্য উপাদান। ১৯৮২ সালে নির্মিত ichard Attenborough-এর ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রটি পৃথিবীব্যাপি মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। ইংরেজিতে লেখা মুলক রাজ আনন্দ্, রাজা রাও, আর কে নারায়ণের উপন্যাস পড়ে এ ছবির নির্মাতা গল্পের উপকরণ সাজিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এধরনের ছবি বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। তবে গান্ধী যেমন ভারতের ভাষা-সাহিত্যকে নতুন উদ্দীপনায় মুখরিত করেছিলেন তেমনি বাংলা সাহিত্যকে বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তা ও জীবনযাপন দিয়ে সচকিত করে তুলেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা গল্পের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত পরিস্থিতি, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, মানুষের জন্য ত্যাগের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম বাংলার সহজ-সরল মানুষের কাছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাঁর মৃত্যু ছিল হাহাকারের; সেই অবস্থা তুলে ধরেছেন সাহিত্যিকরা। যদিও কোনো গল্প-উপন্যাসে ‘মুজিববাদে’র অনুপুঙ্খ রূপায়ণ নেই তবু একটি ‘আদর্শ বাঙালি রাজনৈতিক’ জীবনকে কেন্দ্র করে প্রভূত আখ্যান গড়ে উঠেছে। নাগরিক মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে লোকায়ত মানসে মুজিব চিরন্তন হয়ে ওঠার কাহিনীও তৈরি হয়েছে। এই মহানায়ক জীবনকে গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক করে। আর শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের নেতা হওয়ার জন্য তাঁকে হাসিমুখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। সাধারণ জনতার কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রায়, পালায়, কীর্তনে। গান্ধীজি ভারতবর্ষকে ‘সীতা মা’তে পরিণত করেছিলেন আর ব্রিটিশ শাসককে করেছিলেন রাবণের প্রতীক। রামায়ণের ধারণা ঢুকিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে করেছিলেন প্রসারিত কেবল ধর্মভাবকে কাজে লাগিয়ে। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মানুষের অধিকারের কথা বলে। এজন্যই জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তাঁর জীবন, আদর্শ, মতবাদকে কেন্দ্র করে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। চিত্রকলা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা সামনে কোনো বিকল্প দেখতে পাননি। এ কারণে তাঁরা ১৯৭৭ সালের পর সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন কোনো কোনো লেখক। আর সেসময় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছেন সংগোপনে। তারই পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যে নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে। ধনী থেকে গরিব, জ্ঞানী থেকে নিরক্ষর তাঁকে কেন্দ্র করে রচিত ও পরিবেশিত গানের মুগ্ধ শ্রোতা এখনো। যে জনতা নয় মাসের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে ১৫ আগস্টের পরে সেই দেশবাসীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দরদ টের পেয়েছিলেন সকলে। অসহায়, দুখী, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁকে সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন করতে হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, তাঁর অতি সাধারণ জীবন-যাপন তাঁকে লেখকদের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। তিনি যদিও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তাঁর সম্পর্কে কিংবদন্তির প্রয়োজন ছিল না যদিও তাঁকে কেন্দ্র করে স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে নানান রহস্যময় ঘটনার প্রসঙ্গ। রাজা রাও, মুলক রাজ আনন্দ্ এবং আর কে নারায়ণের গল্প-উপন্যাসে গান্ধীকে যেমন কাহিনী বর্ণনায় নানা ঘটনা ও চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে- বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শতাব্দী লালিত মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র। তাঁর আন্দোলন ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, দেশের গুপ্ত কমিউনিস্ট সর্বহারাদের বিরুদ্ধে নয়। বরং সর্বহারারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসেনাদের হত্যা করেছিল তার চিত্র রয়েছে অনেক গল্পে। সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করা ও ভালোবাসায় সকলকে কাছে টানা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশিষ্টতা। অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেওয়া, সৎ ও নীতিপরায়ণ থাকা এবং ভণ্ডামি না করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেওয়া, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা না করা তাঁর সমগ্র জীবনের মুখ্য আদর্শ। বাংলা ও ভিনদেশি শিল্প-সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর সেই চেতনা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্রই। মূলত তাঁর চেতনার প্রভাব শতাব্দী থেকে শতাব্দী প্রসারিত হয়েছে এবং আগামীতে তা বহাল থাকবে। লেখক :  অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/এমএস

Advertisement